বাণিজ্য ঘাটতি কমানোই মূল লক্ষ্য: বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি একটি দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। আমরা ওটার ওপরেই অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি।”
আজ মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, ইতোমধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি।” তবে এখনো সেই চিঠির কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়া পাওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ বশির উদ্দিন আরও বলেন, “আমরা মনে করি, কিছু পণ্য যদি শুল্কমুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে রপ্তানি বাড়বে এবং আমদানি কমে আসবে। যার মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতিও স্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাবে।”
শুল্ক নীতির প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
বৈঠক পরবর্তী আলোচনায় শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গও উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ টেনে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “গতকাল আমেরিকান প্রশাসন বলেছে যে তারা চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে ট্যারিফ আরোপ করেছে। এমনকি তারা আরও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। এরকম এক পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়ায়।”
শুল্ক আরোপে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সামগ্রিকভাবে শুল্ক আরোপের ফলে মানুষের মনে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে আমরা সেটি সামাল দিতে কাজ করছি। আমাদের কাছে একটি বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো রয়েছে যার মাধ্যমে নির্ধারণ করছি কোন কোন পণ্যের মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস সম্ভব।”
বিশ্লেষণ ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্ব
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি সক্ষমতা, বৈশ্বিক বাজার প্রবণতা, কাঁচামাল প্রাপ্যতা ও মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করছে। এর ভিত্তিতে একটি সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের জন্য আমাদের কেবলমাত্র শুল্ক নীতির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজন রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলা, বাজার বহুমুখীকরণ এবং স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এসব বিষয় নিয়েই আমরা কাজ করছি।”
বাণিজ্য ঘাটতির কারণ ও পর্যালোচনা
বর্তমানে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় রপ্তানির তুলনায় অনেক বেশি। রপ্তানিনির্ভরতা বেশি কিছু নির্দিষ্ট খাতে সীমাবদ্ধ থাকায় বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শেখ বশির উদ্দিন বলেন, “আমাদের রপ্তানি অনেকাংশেই তৈরি পোশাক শিল্প নির্ভর। তবে এখন আমরা চামড়া, আইটি, ওষুধ, কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমদানির ক্ষেত্রে আমরা দেখছি উচ্চমূল্যের ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি এবং কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদের বাণিজ্য ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আশাবাদ
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনা জোরদার করছি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আমাদের বড় বড় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে আরও কার্যকর চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের লক্ষ্যে কাজ চলছে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, “যদি পরিকল্পনাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এক তৃতীয়াংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ একটি সমন্বিত ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি এবং বড় দেশগুলোর শুল্কনীতি বাংলাদেশকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে, তা অতিক্রম করতে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক কৌশল ও সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা।
বাণিজ্য উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট যে, সরকার এই সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে সচেতন এবং ইতোমধ্যেই যথাযথ উদ্যোগ নিয়েছে। সময়োপযোগী এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে একটি অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর দিকে নিয়ে যাবে বলেই আশা করা যায়।