অর্থনীতি

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুঁজছে পাকিস্তানের শিল্পগোষ্ঠী

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও শিল্পখাতে বহুমাত্রিক বিনিয়োগের সুযোগ পর্যবেক্ষণে ঢাকায় সফররত পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এনগ্রো কর্পোরেশন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল সামাদ দাউদ বলেন, “বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতি, যেখানে আমরা দীর্ঘমেয়াদে অংশীদারিত্ব গড়ার সুযোগ দেখছি।”

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার ও বেসরকারি খাতের নানা উদ্যোগের ফলাফল হিসেবে এনগ্রোর এই উচ্চপর্যায়ের সফরটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এই সফরের অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দাউদ সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর সঙ্গে। এই বৈঠকে প্রধানত টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি ও শিল্পখাতে যৌথ বিনিয়োগ ও ভবিষ্যত্‍ সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়।

সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে টেলিযোগাযোগ ও জ্বালানি

এনগ্রো কর্পোরেশনের সিইও সামাদ দাউদ বলেন, “আমরা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্ভাবনা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। বিশেষত, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে সরকার যে নীতিগত সহায়তা দিচ্ছে, তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভোলার গ্যাসসম্পদ দেশের শিল্পখাতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং এতে বিদেশি বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। “আমরা গ্যাসভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে অংশগ্রহণে আগ্রহী,” বলেন দাউদ।

এনগ্রো কর্পোরেশন ইতোমধ্যেই পাকিস্তানে কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, খনিজসম্পদ, খাদ্যপ্রক্রিয়াজাতকরণ ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। বাংলাদেশে এসব খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে তারা যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে।

ইউনূসের টেকসই অংশীদারিত্বের আহ্বান

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এনগ্রোর আগ্রহকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আমরা চাই এমন প্রকল্পে কাজ করতে যা মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। টেকসই এবং ভবিষ্যতমুখী অংশীদারিত্বই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।”

তিনি এনগ্রোর প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশ অনেক কিছু দিতে পারে—শুধু বিনিয়োগকারীদের নয়, বরং পুরো বিশ্বকে। আমরা চাই, বিনিয়োগ শুধু মুনাফাকেন্দ্রিক না হয়ে মানবিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখুক।”

এই সময় ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এনগ্রোর মতো শিল্পগোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও সহযোগিতা

এই সৌজন্য সাক্ষাতে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং প্রধান সচিব সিরাজউদ্দিন মিয়া। সরকারি এই উচ্চপর্যায়ের অংশগ্রহণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের আস্থার বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

লামিয়া মোরশেদ বলেন, “আমরা এমন বিনিয়োগ চাই যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এনগ্রোর মতো সংস্থা যদি আমাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বে আসে, তাহলে তা দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যে এক বিরাট অবদান হবে।”

বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও প্রশংসা

এনগ্রো কর্পোরেশনের সিইও দাউদ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এ অংশগ্রহণ করেন এবং চারদিনব্যাপী এই সম্মেলনকে “আন্তরিক, মানবিক এবং সুসংগঠিত” বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, “বিডা সামিটে এক মানবিক ছোঁয়া ছিল—এটি আন্তরিক, স্বাগতপূর্ণ এবং লক্ষ্যনির্ভর মনে হয়েছে। এক ছাদের নিচে এত শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিকে দেখে আমি অভিভূত।”

এই সম্মেলনে দাউদ বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশ, সরকারপ্রদত্ত প্রণোদনা, শ্রমবাজারের দক্ষতা ও ভৌগলিক অবস্থানের কৌশলগত সুবিধাসমূহ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

বাংলাদেশে এনগ্রোর সম্ভাব্য ভূমিকা

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে এমন একটি সময় চলছে যখন সরকার বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এফডিআই (FDI) আকর্ষণের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর অবকাশ, এবং ব্যবসাবান্ধব নীতিমালার কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে।

এনগ্রো কর্পোরেশন যদি বাংলাদেশে বাস্তব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, তবে তা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই বিনিয়োগ উদ্যোগকে সহজতর করতে পারে। এমন অংশীদারিত্ব ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মত বিশ্লেষকদের।

উপসংহার

এনগ্রো কর্পোরেশনের ঢাকা সফর ও উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো বিদেশি বিনিয়োগে বাংলাদেশের প্রতি বাড়তে থাকা আগ্রহেরই প্রতিফলন। এই সফর শুধু বিনিয়োগ সম্ভাবনার মূল্যায়ন নয়, বরং এক নতুন ধারা সূচনার দ্বারপ্রান্তেও অবস্থান করছে। এমন অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে এবং উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ট সকলে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button