বাজেট ছোট, কিন্তু সুন্দর নয়: বিনিয়োগ-আস্থা সংকটে নীতিগত স্থবিরতা

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য পেশকৃত নতুন বাজেটের আকার ছোট। একে ছোট বললে ভুল হবে না, তবে এর মধ্যে সেই কাঙ্ক্ষিত ‘সুন্দর’-এর ছোঁয়া নেই। বাজেট বক্তৃতা ছোট, ব্যয়ের প্রস্তাব সীমিত, আকাঙ্ক্ষাও সংক্ষিপ্ত। এই সংকুচিত বাজেট প্রস্তাবনার পেছনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের স্বীকারোক্তি—বর্তমান বাস্তবতায় তাঁর হাত-পা বাঁধা।
ছোট বাজেট: প্রথমবারের মতো ব্যতিক্রম
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম বিগত অর্থবছরের তুলনায় ছোট আকারের বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথাগত প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারার বাইরে গিয়ে মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ফলে এবার অবকাঠামোগত বিশাল প্রকল্পের ঘোষণা না দিয়ে সামাজিক খাতের দিকে কিছুটা নজর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো, বাজেটটি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে বড় কোনো স্বস্তির বার্তা আনতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষুদ্র আকারের উদ্যোগ।
বাজেটের মূল আকার ও ঘাটতি
- মোট ব্যয়: ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা
- রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা: ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৯%)
- এর মধ্যে এনবিআর আদায় লক্ষ্যমাত্রা: ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি
- বাজেট ঘাটতি: ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৩.৬%)
- অভ্যন্তরীণ ঋণ: ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি (ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি)
- বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ: ১ লাখ ১ হাজার কোটি
এছাড়া সুদ পরিশোধে এককভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যা বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ। এই উচ্চ সুদ ব্যয় দেশের ঋণ বোঝা বাড়িয়ে তুলছে, যা আগামীতে রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিনিয়োগ ও আস্থা সংকট: বড় বাধা
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সংকট—বিনিয়োগের স্থবিরতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। এর পেছনে কাজ করছে কয়েকটি বড় কারণ:
- ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি: খেলাপি ঋণের হার ২০ দশমিক ২০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার বড় কারণ।
- মূলধন ঘাটতি ও দুর্বল নজরদারি: ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে সতর্ক হলেও এককভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারছে না।
- রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জ্বালানি সংকট: ব্যবসা পরিচালনায় অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
- সরকারি বিনিয়োগেও সংকোচন: মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি, রাজস্ব ঘাটতি এবং উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড়ে ধীরগতি বাজেট বাস্তবায়নকে সীমিত করছে।
রাজস্ব কাঠামো: আবারও পরোক্ষ কর নির্ভর
অর্থ উপদেষ্টা এই বাজেটেও পরোক্ষ কর (যেমন ভ্যাট, শুল্ক ইত্যাদি)-এর ওপর নির্ভরশীল থাকছেন। ফলে সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য বার্ষিক করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। যদিও ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এটি ২৫ হাজার টাকা বাড়ানো হবে।
তবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এতে করে একটি শ্রেণি কিছুটা স্বস্তি পেলেও সার্বিক জনগণের ভোগান্তি নিরসনের ক্ষেত্রে বাজেটের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রশ্নবিদ্ধ।
মূল্যস্ফীতি ও বাস্তবতা
অর্থ উপদেষ্টা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাকে সাফল্য হিসেবে দেখিয়েছেন। ডিসেম্বর ২০২৪-এ যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৮৯ শতাংশ, এপ্রিলে তা কমে এসেছে ৯.১৭ শতাংশে। সরকার আশা করছে, জুনেই এটি ৮ শতাংশে নামবে। কিন্তু বাজার বাস্তবতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নেই বললেই চলে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়েছে, আয় কমেছে।
বাজেট উপস্থাপনেও ব্যতিক্রম
১৭ বছর পর বাজেট দেওয়া হলো সংসদের বাইরে—একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। সর্বশেষ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এই পদ্ধতিতে বাজেট দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সাধারণত বৃহস্পতিবার বাজেট দেওয়ার প্রচলন থাকলেও এবার তা দেওয়া হয়েছে সোমবার—a rare deviation from tradition.
‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ নয়: মূল প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ এফ. সুমাখারের বিখ্যাত তত্ত্ব—‘স্মল ইজ বিউটিফুল’—এ ধারণা অনুযায়ী ছোট বাজেটও কার্যকরী হতে পারে যদি সেটি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়। কিন্তু এবারকার বাজেট আকারে ছোট হলেও মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। বাজেটে নেই ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরির রূপরেখা, নেই দারিদ্র্য হ্রাসের সুস্পষ্ট কৌশল, নেই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির রূপরেখা।
‘বেঁচে থাকো, এগিয়ে যেও না’ বাজেট
এবারের বাজেট মূলত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় একটি ‘স্ট্যাগনেশন বাজেট’। এর মাধ্যমে টিকে থাকা যেতে পারে, কিন্তু গতিশীলতা বা উদ্যম বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাজেট বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত, প্রস্তাব সীমিত, পরিকল্পনা ধীর। অর্থনীতির গতি ফেরাতে হলে শুধু বাজেট নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কার্যকর সংস্কার।