বানিজ্য

ব্যাংকে ঝুঁকি আসার আগেই ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি প্রতিরোধে এখন থেকে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতির পরিবর্তে ‘ওয়াচ অ্যান্ড অ্যাক্ট’ নীতি অনুসরণ করা হবে। এর অর্থ হলো, সম্ভাব্য ঝুঁকি আসার আগেই তা শনাক্ত করে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি’ পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে, যা ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।

গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি’ শীর্ষক এক কর্মশালায় গভর্নর এই নতুন দিকনির্দেশনার কথা জানান। এই কর্মশালায় দেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা অংশ নেন। ব্যাংকিং খাতকে আরও সুদৃঢ়, স্থিতিশীল এবং আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি: একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. জাকির হোসেন চৌধুরী এই নতুন পদ্ধতিকে একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে। আমরা তথ্যের স্বচ্ছতার বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করব।” তিনি আরও জানান, এই পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে এবং সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আগাম শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই পদ্ধতির অধীনে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য, পরিচালন পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, ঋণ বিতরণ ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া, এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর বিশেষ নজর রাখা হবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, সুশাসনের অভাব, এবং আর্থিক অনিয়মের মতো বিষয়গুলো এই খাতের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, “ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার উচিত বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা এবং সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।”

ডেপুটি গভর্নর কবির আহাম্মদ বলেন, “আমাদের সীমিত সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সম্পদের কার্যকর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও জানান, ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি ব্যাংকগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।

কর্মশালার বিস্তারিত

কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রব ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি বিষয়ে একটি বিস্তারিত উপস্থাপনা দেন। তিনি ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং এই নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ কীভাবে কার্যকর হবে তা তুলে ধরেন। এছাড়া, গভর্নরের উপদেষ্টা সাবেত ইবনে সিদ্দিকী এবং আহসান উল্লাহ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

কর্মশালায় বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান এবং নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম। তারা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুরুত্বের উপর জোর দেন। মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি ব্যাংকিং খাতকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করবে। এটি ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক হবে।”

ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের গুরুত্ব

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। খেলাপি ঋণ, অপর্যাপ্ত তদারকি, এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলোর উপর জনগণের আস্থা কমছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক মানের হোক। এজন্য সব ব্যাংকের সহযোগিতা প্রয়োজন।” তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন থেকে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা, এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, এই পদ্ধতি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং গ্রাহকদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো সুশাসিত এবং দক্ষ হোক। এজন্য আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলার উপর জোর দিচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল ভূমিকা এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ।

ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এই পদ্ধতি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক স্বচ্ছতা, এবং গ্রাহক সেবার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে। এছাড়া, এটি ব্যাংকিং খাতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উপসংহার

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এই উদ্যোগ ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি ব্যাংকগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত করতে এবং তা প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব হবে। এই উদ্যোগ জনগণের আস্থা অর্জন এবং দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button