বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে হঠাৎ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চাইছে ভারত

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অস্থিরতা ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষিতে ভারতের কূটনৈতিক কৌশল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের বন্ধু ও কৌশলগত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু দূরত্ব রেখে ভারত এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়ার চেষ্টা করছে। এ খবরটি কেবল আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ও বাণিজ্যিক জটিলতাতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের উত্তেজনা ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের হোয়াইট হাউস মধ্যাহ্নভোজ বৈঠক ভারতের কূটনৈতিক বিশ্বে বড় ধরনের অবাঞ্ছিত সঙ্কট তৈরি করেছে। ভারতীয় সরকার গোপনে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এটি ভারতের জন্য “লাল রেখা” বলে ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে এত গুরুত্ব দিয়ে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভুল সংকেত দিচ্ছে, যা ভারতের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে।

ভারত বিশেষ করে দাবি করে, পাকিস্তান বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে ভারতীয় সীমানায় ঘাটতি করছে। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু ভারতের উদ্বেগ যৌক্তিক কারণ গত কয়েক দশকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা লেগেই থাকে।

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিধাসূচক নীতি ও ভারতের অবস্থান

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির পরিবর্তন ও পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা নতুন করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে টান সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বাণিজ্য নীতি ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের রাজনৈতিক অপ্রত্যাশিত আচরণ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের প্রতি ঘনিষ্ঠতা ও ভারতের উদ্বেগ উপেক্ষা করা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।”

ভারত-চীন সম্পর্ক: নতুন দিকনির্দেশনা

ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে বর্তমানে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা শিথিলতা এবং পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় ভারতের কৌশলগত মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন ও গড়ার চেষ্টা করছে।

২০২০ সালের পরে সীমান্তে চীন-ভারত সংঘর্ষ ও সামরিক উত্তেজনার পর ভারত চীনের প্রতি কঠোর ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বেইজিং সফর এবং ভারত চীনের বিনিয়োগে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করার প্রস্তুতি এই পরিবর্তনের প্রমাণ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগের প্রক্রিয়া দুই দেশের জন্যই উপকারী হতে পারে, কারণ চীন দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি।

ভারতের কূটনৈতিক নতুন কৌশল ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখন একটি বহুমুখী কৌশলে পরিচালিত হচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের গতি কিছুটা ধীর হলেও অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নতুন পথ তৈরি হচ্ছে।

ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান হর্ষ পন্ত বলেন, “ভারত ও চীন উভয়ের মধ্যেই একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি প্রয়োজনীয়।”

তবে ভারতীয়রা খুব সাবধানে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, কারণ চীন পাকিস্তানের প্রধান মিত্র ও সহযোগী। ভারত চায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি না হোক, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর।

যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ভারত: সামরিক ও কূটনৈতিক অস্থিরতা

২০২৫ সালের মে মাসে কাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তান মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ভারতের দাবি পাকিস্তান বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহায়তা দিয়ে কাশ্মীরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের হোয়াইট হাউস সফর ভারতীয় কূটনীতিতে ব্যাপক বিরক্তির সৃষ্টি করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আপত্তি জানিয়েছে।

বাণিজ্য ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতি ও পাকিস্তান সম্পর্কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে, যা দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের জটিলতার ইঙ্গিত।

ভারতীয় কূটনীতির বহুমাত্রিক দৃষ্টি

বর্তমান সময়ে ভারত কূটনীতিতে বহুমাত্রিক কৌশল গ্রহণ করেছে। একটি দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করতে চাইলেও অন্যদিকে চীনকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার জটিল রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে নিজের জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা, যা এখন বহুপক্ষীয় সম্পর্কের মাধ্যমে সম্ভব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button