দুষ্কৃতকারীরা আবারও নগদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংক

মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) খাতে অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ আবারও দুষ্কৃতকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অবৈধ ই-মানি তৈরি এবং প্রশাসনিক অস্থিরতার অভিযোগ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর ফলে সাধারণ গ্রাহকের অর্থ নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
শনিবার (১৭ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। তিনি জানান, আদালতের এক সাম্প্রতিক রায়ের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এবং সেই শূন্যতা কাজে লাগিয়ে পুরনো দুর্নীতিগ্রস্ত মহল আবারও প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
আদালতের রায় ও প্রশাসক দল প্রত্যাহার
গত ১৫ মে হাইকোর্টের এক আদেশে ‘নগদ’-এ সরকার নিয়োগকৃত প্রশাসক দলের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডাক বিভাগ—এই দুই প্রতিষ্ঠানই নগদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থেকে ছিটকে পড়ে। এর আগে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে নগদের প্রশাসনিক দুর্নীতি ও আর্থিক জালিয়াতির তদন্তের অংশ হিসেবে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল।
প্রশাসক নিয়োগের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন্সিক অডিটে উঠে আসে নগদে বিপুল অঙ্কের অর্থ জালিয়াতির তথ্য। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট সৃষ্টি করে প্রায় ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি এবং বিতরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছিল পূর্ববর্তী সরকারের সময়, যখন একাধিক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংসদ সদস্য প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
সিইও পদে বিতর্কিত নিয়োগ ও কর্মকর্তা ছাঁটাই
আদালতের রায়ে প্রশাসক পদ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পুনর্বিন্যাস শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ, যারা অর্থ তছরুপে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদেরই একজন—সাবেক পরিচালক মো. সাফায়েত আলম—নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার নেতৃত্বে গত দুই দিনে ২৩ জন শীর্ষ কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আরও দুই আসামিকে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। একই সঙ্গে মানবসম্পদ বিভাগে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং বিভাগীয় পুনর্বিন্যাসের ফলে নগদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
১৯ মে শুনানি ও আপিল
বাংলাদেশ ব্যাংক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে। আগামী ১৯ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “জনগণের অর্থ নিরাপদ রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। আদালতের আদেশে আমরা দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছি, তবে আমরা চাই এই আদেশ প্রত্যাহার হোক এবং আমরা আবার নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসি।”
আগের অনিয়ম ও সরকারের ভূমিকা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে নগদ ছিল ডাক বিভাগের সঙ্গে অংশীদারত্বে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনে ছিল রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ। সরকারি ভাতা বিতরণ, ভুয়া এজেন্ট ও পরিবেশকের মাধ্যমে ই-মানি তৈরি, এবং গ্রাহক নিয়োগে নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম নগদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, নগদের অর্থ তছরুপের ঘটনায় সাবেক এবং বর্তমান ডাক মহাপরিচালকসহ ২৪ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন নগদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সিইও-ও। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রশাসন পরিবর্তনের পর তারা প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে পরিচালনা করতে শুরু করে। কিন্তু আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত আবার সেই অবস্থানে ফেরত যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা
বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা করছে, আদালতের রায় কার্যকর থাকা অবস্থায় দুষ্কৃতকারীরা প্রতিষ্ঠানটিতে আবারও অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারে। অতীতে যেভাবে ভূয়া এজেন্ট দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ ই-মানি তৈরি করা হয়েছিল, সেই ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি রয়েছে।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও দায়িত্ব ফিরে পেতে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, “আমরা আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলছি। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও আমরা জনগণের অর্থ নিরাপত্তায় আপসহীন। আশা করছি, আপিল বিভাগে আমাদের আবেদন বিবেচনা করে যথাযথ নির্দেশনা দেবে।”