চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলে জোরালো পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। বুধবার (২৮ মে) তিনি এই ঘোষণা দেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন শিক্ষার্থী এবং সংবেদনশীল বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বৃহস্পতিবার (২৯ মে) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই নতুন নীতি অনুসারে, চীন ও হংকং থেকে আগত ভিসা আবেদনকারীদের জন্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা হবে। এছাড়া, মার্কিন দূতাবাসগুলোতে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভিসার আবেদন সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার চীনা শিক্ষার্থীর জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যারা ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করেছে।
পটভূমি এবং প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের একটি ধারাবাহিক পদক্ষেপের অংশ। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে। চীনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সংবেদনশীল বিষয় যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, অথবা সামরিক গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষেত্রে পড়াশোনা করছেন, তাদেরকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
মার্কো রুবিও তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, “আমাদের নতুন ভিসা নীতি আমেরিকাকে প্রাধান্য দেয়, চীনকে নয়।” তিনি আরও জানান, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করবে এবং তাদের ভিসা বাতিল করবে। এই নীতি কেবল বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, ভবিষ্যতে চীন ও হংকং থেকে আগত শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রেও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করবে।
শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে চীনা শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী, ভারতের পরেই। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী ছিলেন চীন থেকে আগত। এই শিক্ষার্থীরা মার্কিন অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, কারণ তারা সাধারণত দেশীয় শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি টিউশন ফি প্রদান করে। তবে, এই নতুন নীতির ফলে অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হতে পারে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার চীনা শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল। এই পদক্ষেপ মার্কিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-এর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
কিছু শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য আসার সিদ্ধান্তে এখন অনুতপ্ত। একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা এখানে শিক্ষার জন্য এসেছি, কিন্তু এখন আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।” এই নীতির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে যারা সংবেদনশীল বিষয়ে গবেষণা করছেন।
চীনের প্রতিক্রিয়া
চীন এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চীনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, “আমরা মার্কিন পক্ষকে চীনের শিক্ষার্থীদের সহ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি।” তবে, চীন এখনও এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়নি।
এই নীতি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা ইতিমধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মতো বিষয়ে উত্তপ্ত। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ চীনের পক্ষ থেকে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা দুই দেশের মধ্যে শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে আরও সীমিত করবে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্বেগ
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই নীতির বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, এই পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতা এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকারের ওপর আঘাত হানছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-এর ওপর নির্ভরশীল, এবং এই নীতি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক বলেন, “আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ধরনের নীতি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।” এছাড়া, কিছু শিক্ষাবিদ মনে করেন, এই পদক্ষেপ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈচিত্র্য এবং গবেষণার গুণগত মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে যাচাই-বাছাই
ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে শিক্ষার্থী ভিসার আবেদনকারীদের সামাজিক মাধ্যমের তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কো রুবিওর নির্দেশনা অনুযায়ী, মার্কিন দূতাবাসগুলো নতুন ভিসা আবেদনের সাক্ষাৎকার বন্ধ করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আবেদনকারীদের সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট, রাজনৈতিক মতামত, এবং অন্যান্য কার্যক্রম বিশ্লেষণ করা হবে।
এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে কিছু অধিকারকর্মী বলেছেন, এটি শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতার উপর হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, যেসব শিক্ষার্থী প্যালেস্টাইন সমর্থনকারী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বা গাজা যুদ্ধবিরোধী মতামত প্রকাশ করেছেন, তাদের ভিসা বাতিলের ঝুঁকি রয়েছে। তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই ধরনের কার্যক্রমের আড়ালে ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ ছড়ানো হচ্ছে, যা তারা মেনে নেবে না।
আইনি প্রতিবন্ধকতা
ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ববর্তী ভিসা বাতিলের পদক্ষেপগুলোর অনেকগুলোই আদালতের রায়ে স্থগিত হয়েছে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিকারকর্মীরা এই নীতির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নীতিও আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, বিশেষ করে যদি এটি শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে বলে প্রমাণিত হয়।
বৈশ্বিক প্রভাব
এই নীতি কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে না, বরং অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য আগ্রহী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা এখন অন্যান্য দেশ যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বা যুক্তরাজ্যের দিকে ঝুঁকতে পারে। এটি মার্কিন উচ্চশিক্ষা খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসা নীতি চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত করছে না, বরং মার্কিন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক ও একাডেমিক স্থিতিশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ভবিষ্যতে এই নীতির বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী নজর থাকবে।