যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত: মন্দার শঙ্কা ও ট্রাম্পের শুল্কনীতি

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, যা দেশটিতে সম্ভাব্য মন্দার আশঙ্কা উসকে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্যনীতির—বিশেষ করে পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে—দ্বিতীয় প্রান্তিকেও অর্থনৈতিক সংকোচন দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই ধীরগতির প্রভাব বৈশ্বিক বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথম প্রান্তিকেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ০.৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অথচ এর আগের প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টিতে জিডিপি বেড়েছিল ২.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র এক প্রান্তিকের ব্যবধানে অর্থনীতির গতি হঠাৎই থমকে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভোক্তাব্যয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় বিনিয়োগ ও পণ্যের মজুত বেড়ে গেছে, যার ফলে এই সংকোচন ঘটেছে। সিএনএন বলছে, এটি ২০২২ সালের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কোনো প্রান্তিকে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখালো।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
অর্থনীতির এই দুর্বলতার পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘প্রতিশোধমূলক শুল্কনীতি’কে দায়ী করছেন অনেকে। এপ্রিল মাসের শুরুতে ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। যদিও অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পরে এই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন তিনি। তবে চীনের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক বজায় রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “স্বল্পমেয়াদে কিছুটা মন্দা এলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাব আমরা।” এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, “এই নীতিই যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসের সেরা অর্থনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যাবে।”
অর্থমন্ত্রী ও প্রশাসনের সতর্ক বার্তা
ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থমন্ত্রী স্টক বেসেন্ট স্বীকার করেছেন, “বর্তমানে অর্থনীতি দুর্বল, তবে এটা বলা এখনো খুব তাড়াহুড়া হবে যে আমরা মন্দার মধ্যে পড়েছি।” একইসঙ্গে তিনি জানান, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কিছুটা সময় লাগবে এবং পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নীতি নির্ধারণ করা হবে।
বৈশ্বিক প্রভাব ও উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক ধীরগতির প্রভাব সীমিত থাকছে না কেবল দেশটিতেই। রয়টার্সের এক সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আস্থা কমেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশই চলতি বছরে বৈশ্বিক মন্দার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তিন মাস আগেও তারা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাল্টা শুল্ক নীতির কারণে ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। এতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া উচ্চ শুল্কের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, যা নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করছে।
স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষকদের মত
স্টেট স্ট্রিট গ্লোবাল অ্যাডভাইজরসের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান কৌশলবিদ টিমোথি গ্রাফ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। সব শুল্ক যদি তুলে নেওয়াও হয়, তবু দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে সুদের হার বাড়িয়ে কিছুটা সফল হলেও এখন ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কনীতির কারণে ফের দ্রব্যমূল্যে চাপ তৈরি হচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সুর নরম
তবে চলমান অস্থিরতার মাঝেও কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই পরাশক্তি—সম্প্রতি নিজেদের অবস্থানে নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, “চীনের সঙ্গে একটি ন্যায্য বাণিজ্যচুক্তি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।”
অন্যদিকে, চীনও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যের ওপর আরোপিত ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কে ছাড় দেওয়া শুরু করেছে। এমনকি গোপনে ছাড়ের তালিকা প্রস্তুত করছে দেশটি। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে উভয় দেশই বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে সরে এসে পারস্পরিক স্বার্থে একটি সমঝোতার দিকে অগ্রসর হতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনৈতিক সংকোচন, পাল্টা শুল্কনীতি এবং বাণিজ্যিক অস্থিরতা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন করে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফলের প্রত্যাশা করছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে আস্থাহীনতা ও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতি একটি আশার আলো হয়ে থাকতে পারে।