আঞ্চলিক

চট্টগ্রামে দেশের প্রথম মনোরেল নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর

চট্টগ্রাম নগরীর পরিবহন খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হলো আজ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মনোরেল নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। রোববার সকালে নগরীর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন চসিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান—জার্মান-মিশরীয় যৌথ উদ্যোগ ওরাসকম এবং আরব কন্ট্রাক্টর গ্রুপ।

এই সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের মনোরেল প্রযুক্তির যাত্রা, যার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠান দুটি চট্টগ্রামে মনোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করবে। এরপর প্রকল্পের অর্থায়ন, নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “এই মনোরেল প্রকল্প নগরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ। নগরীর ক্রমবর্ধমান যানজট, যাত্রীচাপ এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূরীকরণে এটি হবে যুগোপযোগী ও টেকসই সমাধান।”

প্রকল্পের সম্ভাব্য রূপরেখা

প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত মনোরেল লাইনটি হবে প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এতে থাকছে ৩২ থেকে ৩৩টি স্টেশন। পুরো নগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মনোরেল লাইন চট্টগ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাত্রী পরিবহন করবে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিটে। এতে প্রতিদিন লক্ষাধিক যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, মনোরেল প্রকল্পটি চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক অঞ্চল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে সংযুক্ত করবে। এতে করে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও সাধারণ যাত্রীদের জন্য সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনোরেল হলো আধুনিক, পরিবেশবান্ধব এবং স্বল্প ব্যয়ে নির্মাণযোগ্য একটি রেল ব্যবস্থা। মেট্রোরেলের তুলনায় মনোরেলের নির্মাণ খরচ অর্ধেক এবং অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে কম জায়গা দখল করে। এতে যানজট নিরসনের পাশাপাশি শহরের দৃষ্টিনন্দনতা রক্ষা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও অর্থায়ন

চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান ওরাসকম এবং আরব কন্ট্রাক্টর গ্রুপ নির্মাণ খাতে বিশ্বব্যাপী পরিচিত নাম। ওরাসকম মিশরের একটি বৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, যা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বহু দেশে পরিবহন অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করেছে। অপরদিকে আরব কন্ট্রাক্টর গ্রুপও বিশ্বের একাধিক দেশে রেল ও সড়ক অবকাঠামো প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছে।

এই দুই প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে মনোরেল নির্মাণে শুধু প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নয়, বরং সম্ভাব্য অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ কাঠামো প্রস্তুতের দায়িত্ব নেবে। চসিকের কর্মকর্তারা জানান, সরকারকে বড় অঙ্কের তহবিল ব্যয় না করেই এই প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং বাণিজ্যিক রাজধানী। প্রতিদিন এই শহরে কয়েক লক্ষ মানুষ যাতায়াত করে থাকেন, যার ফলে রাস্তাঘাটে তীব্র যানজট একটি নিত্যদিনের সমস্যা। বিশেষ করে পোর্ট কানেকটিভিটি ও শহরের অভ্যন্তরীণ সড়ক ব্যবস্থাপনায় চরম চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমান যানজট পরিস্থিতি চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া চট্টগ্রামের টেকসই নগরায়ণ সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে মনোরেল হতে পারে একটি আদর্শ সমাধান।

চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা

নগরবাসীর মধ্যে এই প্রকল্প ঘিরে ব্যাপক আগ্রহ ও আশাবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, “চট্টগ্রামের জন্য এটি ঐতিহাসিক একটি দিন। আমরা আশা করি, এটি আর একটি অসমাপ্ত স্বপ্নে পরিণত হবে না।”

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “মনোরেল হলে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতি আসবে। কর্মঘণ্টা নষ্ট না হয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে।”

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

যদিও এই প্রকল্পের সম্ভাবনা ব্যাপক, তবে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় একাধিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন—জমি অধিগ্রহণ, বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামোর সঙ্গে সমন্বয়, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন এবং দীর্ঘমেয়াদী নগর পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, প্রকল্পটি যেন জনস্বার্থ, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এ ছাড়া পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।

উপসংহার

বাংলাদেশের জন্য এটি একটি নতুন যাত্রা। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের অন্য শহরে এমন আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার সূচনা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। চট্টগ্রামে মনোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শুধুমাত্র একটি শহরের উন্নয়ন নয়, বরং দেশের নগর পরিকল্পনা ও পরিবহন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক সৃষ্টি হবে।

এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের উন্নয়নচিত্র আমূল পরিবর্তন হবে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button