আঞ্চলিক

শহীদ আবু সাঈদের মাকে নিয়ে কটূক্তি, পিরোজপুরে পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের মাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় পিরোজপুর আদালতে কর্মরত এক পুলিশ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এলাকা।

ঘটনাস্থলে কটূক্তি এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনা

বুধবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে পিরোজপুর জেলা জজ আদালতের সামনে একটি চায়ের দোকানে ঘটে যায় এক অস্বস্তিকর ঘটনা। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল মাসুদ রেজা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক পদযাত্রা ঘিরে সংঘর্ষের ভিডিও দেখে কটূক্তি করেন গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া আবু সাঈদের মাকে নিয়ে।

ঘটনাস্থলে থাকা স্থানীয় জনতা বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেন এবং কনস্টেবল মাসুদকে ঘিরে ফেলেন। পরিস্থিতি কিছু সময়ের জন্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে খবর পেয়ে পিরোজপুর থানার পুলিশ গিয়ে ওই পুলিশ সদস্যকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার এবং পুলিশ সুপারের নির্দেশ

পিরোজপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রবিউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, অভিযুক্ত কনস্টেবল মাসুদ রেজাকে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।

পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ আবু নাসের নিজে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও এ ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শহীদ আবু সাঈদ: গণঅভ্যুত্থানের সাহসী মুখ

১৯৯০ সালের জুলাই বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদ ছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের এক অন্যতম তরুণ মুখ। পেশাগতভাবে একজন ছাত্র হলেও, সাহসিকতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে তিনি অল্প বয়সেই জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তার পরিবারের প্রতি জাতির রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

এমন একজন শহীদের মা সম্পর্কে প্রকাশ্যে অশালীন মন্তব্য শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের চরম অবমাননা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্যে তারা চরম ক্ষুব্ধ হন। অনেকেই ঘটনাস্থলে ভিড় করে প্রতিবাদ জানান এবং মাসুদ রেজাকে জবাবদিহির জন্য চাপ দিতে থাকেন।

পিরোজপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জহিরুল হক বলেন, “শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে স্থানীয়রা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আমরা খবর পেয়ে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করি এবং বিষয়টি জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই।”

বিভাগীয় ব্যবস্থা ও তদন্ত প্রক্রিয়া

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মাসুদ রেজার মন্তব্যের ভিডিও কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতির ভিত্তিতে তদন্ত চলবে। বিভাগীয় তদন্তে তার দোষ প্রমাণিত হলে চাকরি হারানোসহ ফৌজদারি মামলার মুখোমুখিও হতে পারেন তিনি।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারী দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এ ধরনের বক্তব্য শুধু শৃঙ্খলা ভঙ্গই নয়, বরং ‘Conduct unbecoming of an officer’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে পুলিশ রেগুলেশনের আওতায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

অতীতেও ঘটেছে এমন বিতর্ক

এটি প্রথম নয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের অসতর্ক বা উদ্দেশ্যমূলক মন্তব্যের কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। অতীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন।

বিশেষ করে, শহীদদের পরিবার বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কটূক্তি করার ঘটনা জাতিগতভাবে সংবেদনশীল বলে বিবেচিত হয়, এবং তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান

সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ শুধু তাদের ব্যক্তি চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বও করে। তাই জনসম্মুখে দায়িত্বশীল আচরণ বজায় রাখা তাদের নৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনার দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের সচেতনতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ। তবে একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

সারসংক্ষেপ  

গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদের মাকে নিয়ে করা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুধু একজন পুলিশের ব্যক্তিগত অসদাচরণ নয়, বরং একটি জাতির ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও সম্মানবোধের ওপর আঘাত। প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও, এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা জরুরি।

তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণগত শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত?
এম আর এম – ০৪০১, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button