বিশ্ব

ভারতের হুঁশিয়ারি: এক ফোঁটা পানিও যাতে পাকিস্তানে না যায়, তা নিশ্চিত করব

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি এখন নতুন করে উত্তপ্ত বিতর্কের কেন্দ্রে। ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘সিন্ধু নদী উপত্যকার কোনো পানিও যাতে পাকিস্তানে প্রবাহিত না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।’ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এই অবস্থান দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি করেছে।

বৈঠক শেষে কড়া বার্তা

গতকাল শুক্রবার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ডাকা এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেওয়ার পর জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত পাতিল এই মন্তব্য করেন। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ পোস্ট করে তিনি বলেন, “সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে মোদি সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আইনি ও জাতীয় স্বার্থে গৃহীত হয়েছে। এক ফোঁটা পানিও পাকিস্তানে যাবে না।”

বৈঠকে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এখনই কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়েও পরিকল্পনা হচ্ছে।

ভারতের বিকল্প পরিকল্পনা

ভারতের সিন্ধু জল কমিশনারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার সাক্সেনা বৈঠকের পর জানান, উচ্চ অববাহিকার দেশ হিসেবে ভারতের হাতে একাধিক বিকল্প রয়েছে। তবে বিস্তারিত পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভারতের কাছে এই মুহূর্তে যথেষ্ট জলাধার বা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, যার মাধ্যমে পানি পুরোপুরি আটকে দেওয়া সম্ভব হবে। তাই তিন স্তরের পরিকল্পনা—তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির কথাই এখন ভাবছে দিল্লি।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

ভারতের এই ঘোষণার পরপরই পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানায়, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা যুদ্ধের সমতুল্য। পাকিস্তানের বিরোধী দল পিপিপির নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, “সিন্ধু নদ আমাদের, আমাদেরই থাকবে। সেখানে হয় জল বইবে, নয়তো তাদের (ভারত) রক্ত।”

পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত সরাসরি আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির লঙ্ঘন। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তান অভিযোগ তুলতে পারে।

সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির ইতিহাস

১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে এই চুক্তি হয়েছিল, যেখানে মধ্যস্থতাকারী ছিল বিশ্বব্যাংক।

চুক্তি অনুযায়ী, ছয়টি নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়। সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব নদীর অধিকাংশ পানি ব্যবহারের অধিকার পায় পাকিস্তান, আর রবি, বিয়াস ও শতদ্রু নদীর অধিকাংশ পানি ব্যবহারের অধিকার পায় ভারত। তবে এর মধ্যে ভারতের কিছু সীমিত পরিমাণ পানি ব্যবহারের অধিকার ছিল কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে।

এতো বছরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করলেও সিন্ধু চুক্তি অক্ষত থেকেছে। এই প্রথমবার ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি সাময়িক স্থগিত রাখার ঘোষণা দিল।

ভারতের বাস্তব চ্যালেঞ্জ

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত যদি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের পানি সরবরাহ বন্ধ করতে চায়, তবে তার জন্য বিশাল জলাধার, ড্যাম এবং পানিবাহী অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন। বর্তমানে এমন কোনো বড় প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের অবস্থায় নেই। বিদ্যমান নদী অববাহিকায় বড় বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘ সময়, বিপুল অর্থ এবং পরিবেশগত ছাড়পত্রের প্রয়োজন হবে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানকে পানি বঞ্চিত করা ভারতের পক্ষে বাস্তবিকভাবে কঠিন।

কাশ্মীরের প্রতিক্রিয়া

জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ভারতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “আমরা কাশ্মীরিরা কখনো এই চুক্তির পক্ষে ছিলাম না। সিন্ধু চুক্তি কাশ্মীরের মানুষের জন্য অত্যন্ত অন্যায্য ছিল।” তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “চুক্তি স্থগিত রাখার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে, সেটি এখন সময়ই বলে দেবে।”

কাশ্মীরের অনেক নাগরিক মনে করেন, সিন্ধু নদ ও তার শাখানদীগুলির পানি ব্যবহারে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তারা কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছেন।

ভবিষ্যৎ কী বলছে?

বিশ্লেষকদের মতে, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত রাখা কেবল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কেই নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ পানি একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করলে তা আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে ভারত যদি সফলভাবে নদীর পানি নিজের দেশে ধরে রাখতে পারে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন করে, তাহলে পাকিস্তানের কৃষিকাজ ও পানির সরবরাহে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। বিশেষ করে সিন্ধু অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের নতুন পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একদিকে কূটনৈতিক চাপ, অন্যদিকে বাস্তব নির্মাণ সমস্যা—দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে এগোতে হবে ভারতকে। আর পাকিস্তানও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই পানি যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয়—কূটনৈতিক সমাধান, নাকি আরও বড় উত্তেজনা?

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button