বাংলাদেশ

ট্রলিং ট্রলারে অবৈধ ‘বেহুন্দি’ জাল: কমছে মাছের প্রজনন

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবৈধভাবে কাঠের ছোট ট্রলারগুলো যান্ত্রিক ট্রলিং ট্রলারে রূপান্তর করে ছোট ফাঁসের ‘বেহুন্দি’ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে শুধু মাছ ধরা হচ্ছে না, বরং মাছের পোনা, ডিম এবং মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যও ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে সাম্প্রতিক তিন বছরে মাছের প্রজনন অনেক কমে গেছে এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে।

অবৈধ ট্রলার রূপান্তর ও তার প্রভাব

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা থেকে শুরু হয়ে পটুয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রামের কাঠখালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে অবৈধ ট্রলার রূপান্তরের ঘটনা। কাঠের ছোট ট্রলারগুলোকে যান্ত্রিকভাবে ট্রলিং ট্রলারে রূপান্তর করা হচ্ছে। এতে বসানো হয় ছোট ফাঁসের ‘বেহুন্দি’ জাল। এই ছোট ফাঁসের জালে গিয়ে আটকে পড়ে মাছের পোনা, মা মাছের ডিম এবং তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য।

একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বললে জানা গেছে, রূপান্তরিত এসব ট্রলারে মাইক্রো ইঞ্জিন থেকে শুরু করে হাইড্রোলিক উইঞ্চ, ডিজেল চালিত জেনারেটর, জিপিএস ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে মাছের অবস্থান শনাক্ত করার সুবিধা রয়েছে। এসব ট্রলার মূলত অগভীর সমুদ্র অঞ্চলগুলোতে মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকে, যেখানে মাছের প্রজনন ঘটে।

মহিপুর মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ী মো. মজনু গাজী জানান, একটি সাধারণ কাঠের ট্রলারকে যান্ত্রিক ট্রলারে রূপান্তর করতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। ট্রলার মালিকরা এ ধরনের অবৈধ ট্রলার দিয়ে মাসে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেন। অথচ এসব ট্রলার সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

জেলের কষ্ট ও ভবিষ্যতের ভাবনা

পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামের জেলে আবদুস ছত্তার জানালেন, ‘আগের মত মাছ আর জালে ধরা পড়ছে না। ট্রলিং ট্রলার ছোট পোনা, ডিম সব ধ্বংস করে ফেলছে। আগামী দিনে আমাদের জীবন-জীবিকা কী হবে জানি না।’

জেলেরা বলছেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই অবৈধ কার্যক্রম আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলমাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হওয়ায় মাছের অনুপস্থিতি দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে বিপর্যয়

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) মতে, যান্ত্রিকভাবে টানা জাল ধরা সবচেয়ে বিধ্বংসী পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম। সামুদ্রিক তলদেশের শামুক, ঝিনুক, শৈবাল, প্রবাল, সাগরঘাস ইত্যাদি মাছের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য ও আশ্রয়। কিন্তু এই সব বস্তু জাল দিয়ে ধ্বংস হওয়ায় মাছের খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘দেশে শিল্পভিত্তিক ট্রলার ৪০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাছ ধরতে পারলেও, এসব রূপান্তরিত ট্রলার মাত্র ৬ থেকে ৮ মিটার গভীরতায় ছোট ফাঁসের বেহুন্দি জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। এ ক্ষেত্রে প্রজনন ব্যাহত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।’

আইনি ফাঁকফোকর ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা

অবৈধ ট্রলারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না মৎস্য বিভাগ। কারণ, ট্রলার মালিকরা অবৈধ ট্রলারের বৈধতা দাবি করে আদালতে রিট করে রেখেছেন। রিট চলাকালীন তারা কোনো কঠোর আইন কার্যকর হতে দেয় না। যদিও মৎস্য বিভাগ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে, মালিকরা জরিমানা দিয়ে খুব সহজেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, ‘ট্রলারগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু মালিকপক্ষ বেহুন্দি জালের লাইসেন্স নিয়ে ট্রলারে বসিয়ে নেন। পরে রিট করে নৌযানের বৈধতা চান। এখন পর্যন্ত রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না।’

বাংলাদেশের মাছের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষ করে ইলিশ জাতীয় মাছ দেশের জাতীয় মাছ হিসেবে মানুষের প্রিয়। উপকূলীয় নদী ও সাগরের অগভীর অঞ্চলে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ডিম ছাড়ে এবং পোনা ফেলে। কিন্তু অবৈধ ট্রলার ও বেহুন্দি জালের কারণে এই প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যশিল্পের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

অর্থনৈতিক সুবিধার লোভে অবৈধ ট্রলিং ট্রলার ব্যবসা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে যেমন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি মৎসজীবীদের জীবিকা সংকটে পড়ছে। অবৈধ ট্রলিং ট্রলার বন্ধ না হলে দেশের মৎস্যখাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থাকবে।

সমাধানের পথ

১. আইনশৃঙ্খলা কঠোর করা: অবৈধ ট্রলিং ট্রলার চিহ্নিত করে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
২. মালিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি: মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ট্রলার মালিক ও জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৩. সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার: পরিবেশবান্ধব এবং বৈধ মৎস্য আহরণের পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে।
৪. সামাজিক অংশগ্রহণ: স্থানীয় জনগণ, জেলেরা ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় একতা গড়ে তোলা দরকার।
৫. বৈধ লাইসেন্সিং ও নিয়ন্ত্রণ: বেহুন্দি জালের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং লাইসেন্স ব্যবস্থা জোরদার করা।

‘ট্রলিং ট্রলারে বেহুন্দি জাল’ ব্যবহারের ফলে মাছের প্রজনন কমে যাওয়া এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ভাঙা একটি গুরুতর সমস্যা। দেশের মৎস্যশিল্প ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা আজকের সবচেয়ে জরুরি কাজ। সরকার, মৎস্য বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিলে তবেই সামুদ্রিক সম্পদের সংকট থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button