বিশ্ব

৩৪তম নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা শুরু ২৩ মে

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুজাতিক মহোৎসব হিসেবে পরিচিত ‘নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা’-এর ৩৪তম আসর শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ২৩ মে। চার দিনের এই বৃহৎ আয়োজন চলবে ২৬ মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে (১৫৩-১০ জ্যামাইকা অ্যাভিনিউ, নিউইয়র্ক ১১৪৩২)। বইমেলার আয়োজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন।

৩৪ বছরের ঐতিহ্য বহন করা এই বইমেলা শুধুই একটি সাহিত্য মেলা নয়—এটি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে রূপ নিয়েছে।

প্রস্তুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা সংবাদ সম্মেলনে

এই উপলক্ষে বইমেলার প্রস্তুতি, কর্মসূচি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ১৬ মে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের নবান্ন রেস্তোরাঁয় একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বইমেলার আহ্বায়ক এবং ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান রোকেয়া হায়দার, যিনি বর্তমানে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে মেলার সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন।

সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সিইও বিশ্বজিত সাহা। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের চেয়ারপারসন জিয়াউদ্দীন আহমেদ, কো-চেয়ারপারসন নজরুল ইসলাম ও সউদ চৌধুরী, উপদেষ্টা গোলাম ফারুক ভূঁইয়া এবং সিনিয়র সদস্য ওবায়েদুল্লাহ মামুন।

বক্তারা জানান, এবারের বইমেলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্যাতিমান লেখক, কবি, প্রকাশক এবং সংস্কৃতি কর্মীরা অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে অনেক লেখক-প্রকাশক নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছেন।

বইমেলার উদ্বোধন ও বিশেষ অতিথিরা

২৩ মে সন্ধ্যা ৬টায় বইমেলার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হবে। এবারের বইমেলা উদ্বোধন করবেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও নন্দিত লেখক সাদাত হোসাইন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিন বন্ধু ফিলিস টেইলর

১৯৭১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনা করে, তখন ফিলিস টেইলরের প্রয়াত স্বামী রিচার্ড টেইলর ও তাঁর সহযোদ্ধারা বাল্টিমোর ও ফিলাডেলফিয়া বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ অবরোধ করেন। সেই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতেই বইমেলায় একটি বিশেষ পরিবেশনা থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধ এবং সাহিত্যের সংযোগ

মেলায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি নতুন গ্রন্থের প্রকাশনা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই আলোচনায় অংশ নেবেন বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা বেগম, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিল্ড হাসপাতালের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত থাকবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এবং অধ্যাপক রওনক জাহান। তাদের অংশগ্রহণ বইমেলায় একটি বৈশ্বিক মাত্রা যোগ করবে বলে আয়োজকরা মনে করেন।

বইমেলার আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানমালা

প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলায় পাঠক ও সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য থাকছে নানা রকম অনুষ্ঠানের সমাহার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • লেখক-পাঠক মুখোমুখি আড্ডা
  • নতুন বই নিয়ে আলোচনা
  • স্বরচিত কবিতা পাঠ ও কবিতা আবৃত্তি
  • সাহিত্য বিতর্ক ও সেমিনার
  • সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক ওয়ার্কশপ
  • শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান
  • মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

এছাড়া, একুশে চেতনা পরিষদ, যুক্তরাষ্ট্র-এর সৌজন্যে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনী—‘অমর একুশ: ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস (১৯৪৭–১৯৫৬)’। এই প্রদর্শনী ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথা স্মরণ করাবে প্রবাসী নতুন প্রজন্মকে।

প্রকাশনা সংস্থা ও অংশগ্রহণকারীরা

এবারের বইমেলায় অংশ নিচ্ছে ২৫টিরও বেশি স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা। বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলে থাকবে নানান ঘরানার সাহিত্য, গবেষণা, ইতিহাস ও শিশুতোষ বই।

বইমেলার আয়োজকেরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এবারের আসর হবে আগের সব বছরের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ ও জনসম্পৃক্ত। তারা জানান, মেলা শুধু বই কেনাবেচা নয়—এটি বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার এক শক্তিশালী মাধ্যম।


ইতিহাস ও উত্তরাধিকার

বক্তারা তাদের বক্তব্যে বলেন, ১৯৯২ সালে ‘বাঙালির চেতনা মঞ্চ’ এবং ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’-এর যৌথ উদ্যোগে বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। এরপর এককভাবে মুক্তধারা নিউইয়র্ক এবং বর্তমানে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন এই ঐতিহ্যবাহী মেলার আয়োজন করে আসছে। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনে রয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা সকলেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রবাসে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এটি একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্মিলনের স্থান।

উপসংহার

৩৪তম নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা একাধারে একটি সাহিত্য সম্মেলন, একটি সাংস্কৃতিক উত্সব এবং এক ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণা। এটি বাংলাভাষী মানুষের জন্য শুধু একটি বার্ষিক উৎসব নয়, বরং একটি পরিচয় রক্ষার আন্দোলন। এই মেলা প্রবাসী সমাজে বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখার এক অনন্য উদ্যোগ হিসেবে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা যেমন ভূমিকা রাখছে, তেমনি ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য এটি হয়ে উঠছে এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারের গৌরবময় স্মারক।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button