ঝোপে পুঁতে রাখা ব্যবসায়ীর বস্তাবন্দি দ্বিখণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার

নৃশংস হত্যাকাণ্ডে উত্তাল রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলা। স্থানীয় এক পোলট্রি ব্যবসায়ীর বস্তাবন্দি দ্বিখণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘিরে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
কী ঘটেছে, কোথায় পাওয়া গেছে মরদেহ?
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) সকালে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নের মাঝেরপাড়া এলাকার একটি ঝোপের ভেতর মাটিচাপা দেওয়া অবস্থায় একটি বস্তা থেকে উদ্ধার করা হয় ব্যবসায়ীর দ্বিখণ্ডিত মরদেহ। নিহতের নাম মো. মামুন (৩৫)। তিনি সুগারমিল আদর্শগ্রাম এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয়ভাবে পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা এলাকাটি ঘিরে তল্লাশি চালায়। পরে একটি ঝোপের ভেতর বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায় মরদেহটি। খুলে দেখা যায়, লাশটি দ্বিখণ্ডিত ও বিকৃত অবস্থায় রয়েছে।
নিখোঁজ থেকে মরদেহ উদ্ধার: ৮ দিনের বিভীষিকাময় কাহিনি
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৭ জুলাই বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি মামুন। রাতেই তার স্ত্রীকে ফোন করে তিনি জানান, কিছু জরুরি কাগজপত্র পৌঁছে দিতে হবে রানীরহাট বাজারে। এরপর থেকেই তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
পরদিন, ৮ জুলাই মামুনের নম্বর থেকেই ফোন করে বলা হয়, তাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। মামুনের স্ত্রী বিষয়টি কাউখালী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
পুলিশি অভিযান ও ঘাতকের স্বীকারোক্তি
মামলার তদন্তে নেমে পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান শুরু করে। সোমবার (১৪ জুলাই) রাতে লক্ষ্মীপুর জেলার ভবানীগঞ্জ এলাকার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনের সাবেক কর্মচারী মো. কামরুল ইসলামকে (৩০)।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে কামরুল স্বীকার করে, মামুনকে রানীরহাটে নিজের ভাড়া বাসায় ডেকে নেয়। সেখানে তার স্ত্রী সাথী আক্তারের সহযোগিতায় চায়ের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে অজ্ঞান করা হয় মামুনকে। পরে তাকে হত্যা করে মরদেহ দ্বিখণ্ডিত করা হয় এবং বস্তায় ভরে এনে কাউখালীর মাঝেরপাড়ায় তার ফুফা শ্বশুরবাড়ির পাশে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার করা হয় মামুনের মরদেহ। এরপর পুলিশ গ্রেপ্তার করে কামরুলের স্ত্রী সাথী আক্তারকেও।
হত্যার কারণ কী? ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নাকি প্রতিহিংসা?
কাউখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাইফুল ইসলাম সোহাগ জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, মামুন ও কামরুল একসময় কর্মচারী ও মালিক ছিলেন। তবে কিছুদিন আগে তারা যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পুলিশ মনে করছে, অর্থনৈতিক জটিলতা বা লভ্যাংশ ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এর জের ধরেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।
রাঙামাটি কাপ্তাই সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহেদুল ইসলাম বলেন, “ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসা নিয়ে বিরোধ থেকেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। তবে আমরা আরও তদন্ত করছি—আর কেউ এতে জড়িত কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
নিহতের পরিবার ও স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা এই হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত বিচার ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
মামুনের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার স্বামী কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত না। ব্যবসায় নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কেন ওকে এত নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হলো?”
এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বলেন, “এভাবে কাউকে হত্যা করে বস্তায় ভরে পুঁতে রাখা—এটা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না।”
তদন্তে কী কী পাওয়া গেছে?
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নেশাজাতীয় দ্রব্যের কিছু নমুনা ও হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র। মামলার তদন্তের জন্য কামরুলকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করা হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
পুলিশ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো সহযোগী বা উদ্দীপক থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনবে বলে জানিয়েছে। মামুনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে। পরিবারকে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
সারসংক্ষেপ
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারকেই বিপর্যস্ত করেনি, পুরো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পেশাগত দ্বন্দ্ব হোক বা পারিবারিক প্রতিহিংসা—এভাবে কাউকে হত্যা করার কোনো নৈতিক বা আইনি ভিত্তি নেই। প্রশ্ন হলো, সমাজে এমন অপরাধ প্রবণতা রোধে আমরা কী করছি?
এম আর এম – ০৩৫২, Signalbd.com