বানিজ্য

ঢাকায় অবকাঠামো নির্মাণ খাত নিয়ে তিন দিনের প্রদর্শনী

রাজধানী ঢাকায় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পানি ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো সরঞ্জামাদির ওপর তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ‘সেইফকন-২০২৫’ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ মে ২০২৫) বসুন্ধরা সিটির আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। সেভর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের আয়োজনে এই প্রদর্শনী দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও টেকসই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি তার বক্তব্যে অবকাঠামো খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই ম্যাটারিয়াল ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সেইফকন-২০২৫ এর মতো প্রদর্শনী দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং নতুন প্রযুক্তির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।” তিনি আরও জানান, এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের (সিইএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট হান জিংচাও, গৃহায়ন ও ভবন গবেষণা কেন্দ্রের (এইচবিআরসি) নির্বাহী পরিচালক মো. আবু সাদেক, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (এবিসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, এফইএসসিএবি সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. হাসমতুজ্জামান এবং সেভর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়জুল আলম। প্রত্যেকে তাদের বক্তব্যে অবকাঠামো খাতে উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।

প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু ও অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান

সেইফকন-২০২৫ প্রদর্শনীতে অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পানি ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জার্মানি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি তাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও পণ্য প্রদর্শন করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্মাণ সরঞ্জাম উৎপাদনকারী কোম্পানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি সমাধান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, পানি শোধন ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি প্রদানকারী সংস্থা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের আধুনিক যন্ত্রপাতি নির্মাতারা।

প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কোম্পানি তাদের টেকসই প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব সমাধান প্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সৌর ও বায়ু শক্তির সর্বশেষ প্রযুক্তি প্রদর্শিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া, পানি ব্যবস্থাপনা খাতে উন্নত শোধনাগার প্রযুক্তি এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রদর্শিত হচ্ছে, যা ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে পানি সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সমাধান প্রদান করতে পারে।

প্রদর্শনীর তাৎপর্য ও লক্ষ্য

সেইফকন-২০২৫ প্রদর্শনী বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন ও টেকসই প্রযুক্তির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, এবং এই প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রদর্শনীটি দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করছে, যেখানে তারা তাদের অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সমাধান শেয়ার করতে পারে।

এই প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার: অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিনিময়।
  • টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশবান্ধব উপকরণ এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
  • বিনিয়োগ আকর্ষণ: অবকাঠামো খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি।

দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত সময় ও সুযোগ

প্রদর্শনীটি ৩০ মে (শুক্রবার) থেকে ১ জুন (শনিবার) পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দর্শনার্থীরা এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল পরিদর্শন করতে পারবেন, সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং সম্ভাব্য ব্যবসায়িক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন। এছাড়া, প্রদর্শনীতে বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে বিশেষজ্ঞরা অবকাঠামো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের সর্বশেষ প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করবেন।

অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যার চাপের কারণে পানি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং টেকসই নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। সেইফকন-২০২৫ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনী সমাধান প্রদানের একটি সুযোগ তৈরি করেছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য অংশ সংগ্রহ করা। এই প্রদর্শনী এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কারণ এখানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি প্রদর্শিত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সেইফকন-২০২৫ শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনী নয়, বরং বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণের একটি প্ল্যাটফর্ম। এই ধরনের আয়োজন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এছাড়া, এই প্রদর্শনী দেশের অবকাঠামো খাতের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।

অনুষ্ঠানের আয়োজক সেভর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়জুল আলম বলেন, “আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতকে বিশ্বমানের প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করা। সেইফকন-২০২৫ এই লক্ষ্য অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।” তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতকে আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা রয়েছে।

উপসংহার

সেইফকন-২০২৫ প্রদর্শনী বাংলাদেশের অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই প্রদর্শনী শুধুমাত্র দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করেনি, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগামী দিনগুলোতে এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্বের অবকাঠামো খাতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button