বাংলাদেশ

নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির যাত্রা শুরু

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে নেপালের বিদ্যুৎ রপ্তানি কার্যক্রম। গত ২০২৫ সালের জুনের মাঝামাঝি থেকে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে। এটি নেপালের জন্য আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ বাজারে পা রাখার নতুন এক অধ্যায়। একই সঙ্গে এ ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নেপালের বিদ্যুৎ রপ্তানি উদ্যোগ: আঞ্চলিক সহযোগিতার উদাহরণ

নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫ বছরের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে এই বিদ্যুৎ রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে অংশীদার রয়েছে:

  • বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)
  • ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ ব্যবসায়িক নিগম (NTPC)
  • নেপাল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ (NEA)

এই চুক্তির মাধ্যমে প্রতিবছর বর্ষাকালীন সময় (জুন থেকে নভেম্বর) বাংলাদেশের জন্য নেপাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এর ফলে দুই দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য মিলবে।

নেপালের বিদ্যুৎ অবকাঠামোর উন্নতি: আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (International Energy Agency, IEA) জানিয়েছে, নেপাল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত গতিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে সফল হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেশের প্রায় ৮০% মানুষ বিদ্যুৎবিহীন থাকলেও এখন প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষের জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে নেপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩,৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, যা বর্ষাকালে দেশীয় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। ২০২১ সালের শেষে নেপাল প্রথমবার ভারতের কাছে বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করেছিল। এবার সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ রপ্তানির পথ সুগম হয়েছে।

নেপালের জ্বালানিমন্ত্রীর বক্তব্য

নেপালের জ্বালানিমন্ত্রী দীপক খড়কা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (আগের টুইটার)-এ উল্লেখ করেছেন, “এটি নেপালের জন্য জ্বালানি রপ্তানির যাত্রার সূচনা। আমাদের বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ততা এবং আঞ্চলিক জ্বালানি নিরাপত্তায় অবদান রাখার অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন এটি।”

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও সুযোগ

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে দেশের গ্রিডে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বর্ষাকালে, যখন দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ন সমাধান।

নেপালের জলবিদ্যুৎ উৎস থেকে সরবরাহিত এই বিদ্যুৎ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই হওয়ায় বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির লক্ষ্য পূরণেও সহায়তা করবে। এটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্বন নির্গমন হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।

ভারতের মধ্যস্থতা: আঞ্চলিক শক্তি সহযোগিতায় মধ্যস্বত্বভোগী

ভারত এখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। নেপাল থেকে সরবরাহিত বিদ্যুৎ ভারতের ভূখণ্ড হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছছে। ভারতের বৃহৎ বিদ্যুৎ অবকাঠামো এবং আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থা এই সহযোগিতাকে সম্ভব করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা আঞ্চলিক শক্তি বাজার গড়ার ক্ষেত্রে আরও মাইলফলক স্থাপন করতে পারে।

জলবিদ্যুৎ: নেপালের শক্তি সম্পদের মূল আধার

নেপালের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান এমন যে, দেশটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। হিমালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করেই নেপাল তার বিদ্যুৎ চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি বড় বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করেছে, যা তার উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রপ্তানির সুযোগ তৈরি করেছে। এই জলবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ আঞ্চলিক দেশগুলোর বিদ্যুৎ নিরাপত্তার জন্য খুবই কার্যকর।

আঞ্চলিক শক্তি বাজারের ভবিষ্যৎ

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এই ত্রিপক্ষীয় বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তি একটি যুগান্তকারী উদাহরণ। এটি আঞ্চলিক শক্তি বাজারের বিকাশে উৎসাহিত করবে এবং দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়ন ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এ ধরনের আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য বাড়লে, অঞ্চলটি বিশ্ব শক্তি বাজারে নতুন প্রতিযোগী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারত এই সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল বিদ্যুৎ নয়, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককেও শক্তিশালী করতে পারবে।

সংক্ষেপে:

  • ২০২৫ সালের জুন থেকে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করেছে।
  • ভারতের মাধ্যমে নেপালের বিদ্যুৎ বাংলাদেশে পৌঁছানো হচ্ছে।
  • ৫ বছরের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় এই বিদ্যুৎ রপ্তানি কার্যক্রম চলছে।
  • নেপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে প্রায় ৩,৫০০ মেগাওয়াট।
  • বর্ষাকালে বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
  • এটি নেপালের আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
  • বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে এটি একটি বড় সহায়তা।
  • ভারত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশ-নেপাল-ভারত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের এই নতুন অধ্যায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button