অর্থনীতি

নগদের সিইও অবৈধ, তাঁর পদে থাকার অধিকার নেই: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে মো. সাফায়েত আলম অবৈধ এবং এই পদে বহাল থাকার কোনো আইনগত অধিকার তাঁর নেই। গভর্নর মনে করেন, সাফায়েত আলম বিভিন্ন প্রকার জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।

আজ রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নগদের পরিচালনা সংক্রান্ত একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে গভর্নর এই মন্তব্য করেন। উক্ত সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব; অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং খাত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভার ভেতরের সূত্র থেকে জানা যায়, নগদের অভ্যন্তরে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম এবং এই সংক্রান্ত আদালতে চলমান একাধিক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার দ্রুত এবং কার্যকর সমাধানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থিত সকলেই এই বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছানো অপরিহার্য।

আলোচনায় নগদের জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব উঠে আসে। সভায় এই বিষয়ে প্রাথমিক ঐকমত্য স্থাপিত হয়েছে যে আপাতত বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও ভবিষ্যতে তারা এই দায়িত্বে থাকবে না। এমনকি ডাক বিভাগও ভবিষ্যতে নগদের সরাসরি পরিচালনায় যুক্ত থাকবে না। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে পেশাদার এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে তাদের হাতেই নগদের পরিচালনার ভার অর্পণ করা হবে।

সভা শেষে সাংবাদিকরা গভর্নরের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জানতে চান। তাদের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পূর্বে যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেই মো. সাফায়েত আলমকে কিভাবে পুনরায় নগদের সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘সরকার কোনোভাবেই এটি মেনে নেবে না। এটি সরকারের নীতিগত অবস্থান নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলেছে, সেটাই সরকারের অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে যেহেতু বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন, তাই এই বিষয়ে এর থেকে বেশি কিছু বলা সমীচীন হবে না।’

তবে গভর্নর সাফায়েত আলমের পদে থাকার অধিকার নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘তাঁর (সাফায়েত আলম) নগদের সিইও পদে থাকার কোনো প্রকার অধিকার নেই। আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান হলো, তিনি এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। আমাদের বিশ্বাস, তিনি অবশ্যই জালিয়াতি করেছেন। আমরা মনে করি, তিনি নিঃসন্দেহে দোষী।’

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। প্রশ্নটি ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কঠোর অবস্থানের কারণে ডাক বিভাগের সাথে কি কোনো প্রকার বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন, ‘কোনো ধরনের বিরোধের সৃষ্টি হবে না। ডাক বিভাগ কেন বিরোধ করবে? এখন আপনারা আর কোনো বিরোধ দেখতে পাবেন না।’ গভর্নরের এই মন্তব্য থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডাক বিভাগের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা চলছে এবং উভয় পক্ষই একটি সুষ্ঠু সমাধানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট তারিখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নগদের কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ করে। প্রশাসক নিয়োগের পর পরিচালিত নিরীক্ষায় নগদের অভ্যন্তরে বড় ধরনের আর্থিক জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে ভুয়া পরিবেশক এবং এজেন্টদের দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। এর পাশাপাশি, অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরির মাধ্যমেও আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। এসব অনিয়মের কারণে প্রায় ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব গরমিল ধরা পড়ে।

সাবেক সরকারের আমলে নগদ বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক সুবিধা লাভ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে নগদকে একচেটিয়া সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যা অন্যান্য মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছিল। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানে যখন এই ব্যাপক অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়, তখন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নগদের পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এই গুরুতর আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২৪ জন ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে, যা বর্তমানে বিচারাধীন।

নগদের পরিচালনায় নিযুক্ত প্রশাসক দলের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ জারি করার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক উক্ত স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি আপিল করেছে। আদালত এই আপিলের ওপর শুনানির জন্য আগামী সোমবার দিন ধার্য করেছেন। এই শুনানি নগদের ভবিষ্যৎ পরিচালনা এবং মো. সাফায়েত আলমের সিইও পদে থাকা না থাকার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এই কঠোর এবং স্পষ্ট বক্তব্য নগদের ভবিষ্যৎ পরিচালনা এবং এর নেতৃত্ব নিয়ে একটি নতুন মোড় এনে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আদালত এই বিষয়ে কী রায় দেয় এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী পদক্ষেপ নেয়। তবে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button