বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা এক ধরনের বৈষম্য: সিপিডি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এই সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক এবং অনৈতিক বলে অভিহিত করেছেন। সোমবার (২ জুন) সন্ধ্যায় বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, এই পদক্ষেপ বৈধ পথে আয়কারীদের সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি করবে এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে না।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ: বৈষম্যের অভিযোগ
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা ঠিক হয়নি। এটি বৈধ পথে উপার্জনকারীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি করবে। সৎ করদাতারা যেখানে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর পরিশোধ করেন, সেখানে কালো টাকা সাদা করার জন্য মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তবে এটি কখনোই প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায়ে সফল হয়নি। ড. ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেন, “অতীতে এই সুযোগ দেওয়া হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা থেকে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আদায় হয়নি।” তিনি প্রশ্ন তুলেন, “এই সুযোগ কাদের স্বার্থে দেওয়া হচ্ছে? এটি কি রিয়েল এস্টেট লবির জন্য, নাকি অন্য কোনো গোষ্ঠীর জন্য?”
বাজেটের দর্শন ও বাস্তবতার অমিল
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, “বাজেটের দর্শন হচ্ছে বৈষম্যবিহীন সমাজ গঠন। কিন্তু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এই দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।” তিনি উল্লেখ করেন যে, বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দ খুবই কম। “সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো দরকার ছিল, বিশেষ করে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমানোর জন্য। কিন্তু এই বাজেটে তা পরিলক্ষিত হয়নি,” তিনি যোগ করেন।
বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ কম রাখাকে উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিপিডি। ড. ফাহমিদা বলেন, “এই খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, কারণ এগুলো জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও জানান, রাজস্ব জিডিপির দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিম্নগামী, এবং সম্পদ আহরণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ বা আগ্রহের অভাব রয়েছে।
করমুক্ত আয়সীমা ও শুল্ক যৌক্তিককরণ
বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকায় বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সিপিডি স্বাগত জানিয়েছে। তবে ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় এই বৃদ্ধি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। এই প্রেক্ষাপটে করমুক্ত আয়সীমার বৃদ্ধি আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।”
শুল্ক যৌক্তিককরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “কিছু কিছু শিল্প এই পদক্ষেপের ফলে চাপে পড়তে পারে। তবে এটি প্রয়োজনীয় ছিল। সরকারকে এখন ব্যবসায়ের সুবিধা বাড়ানোর জন্য ‘কষ্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।” তিনি পরামর্শ দেন যে, ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সহজ ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
দুর্নীতি ও সংস্কারের প্রশ্ন
কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)ও তীব্র সমালোচনা করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র অনুপার্জিত আয়কে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করবে।” তিনি আরও বলেন, “এই সুযোগের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের প্রভাব বাড়বে, যা সৎ উপার্জনকারীদের জন্য বৈষম্য সৃষ্টি করবে।”
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বারবার দেওয়ার ফলে দুর্নীতিবাজরা মনে করেন, ভবিষ্যতেও এই সুযোগ পাওয়া যাবে। এটি দুর্নীতির একটি দুষ্টচক্র সৃষ্টি করেছে।” তিনি পরামর্শ দেন যে, এই সুযোগ চিরতরে বাতিল করে অবৈধ আয়ের উৎস অনুসন্ধানের মাধ্যমে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ
সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেই। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কোনো শক্তিশালী পরিকল্পনা বাজেটে দেখা যায়নি। এছাড়া, ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এটি অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কোনো নির্দেশনা নেই।”
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন, “বাজেটে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে।” তিনি পরামর্শ দেন যে, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আরও সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
উপসংহার
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সিপিডির সমালোচনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক ও অনৈতিক বলে অভিহিত করা হয়েছে। সিপিডি এবং টিআইবির মতো সংস্থাগুলোর মতে, এই সুযোগ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে এবং সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করে। বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে সিপিডি। সরকারের উচিত এই সমালোচনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এগিয়ে যাওয়া।