বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব বানাতে চীনা বিনিয়োগ চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদনশীল) হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত চীন-বাংলাদেশ ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোববার (১ জুন) এই আহ্বান জানান তিনি।
দিনব্যাপী এই সম্মেলনটি ঢাকার মাল্টিপারপাস কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে চীনের প্রায় ১০০টি কোম্পানির প্রায় ২৫০ জন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার এবং চীন সরকার যৌথভাবে এই আয়োজন করে।
‘উৎপাদন হাবে রূপান্তরে চীন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেন, “বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চীনা বিনিয়োগকারীদের আরও এগিয়ে আসতে হবে। তৈরি পোশাক, জ্বালানি, কৃষি, পাট এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতসহ বহু সম্ভাবনাময় খাত এখানে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ৩০ বছরের নিচে এবং এই তরুণ প্রজন্ম কাজের জন্য প্রস্তুত। এই বিশাল মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ শুধু আঞ্চলিক নয়, একটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।”
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্য
সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের সম্ভাবনা, প্রাসঙ্গিক খাত এবং নীতিগত সুবিধা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা। চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন শিল্প খাতে সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করতে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে বলে উল্লেখ করেন আয়োজকেরা।
চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও সম্মেলনে বলেন, “বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। আমাদের দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ আগামী দিনে দ্বিগুণের বেশি হবে বলে আমরা আশাবাদী।”
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের স্থিতিশীল নীতিনির্ধারণ, তরুণ শ্রমশক্তি এবং কৌশলগত অবস্থান চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আমরা চাই, এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হোক।”
বিশেষ আকর্ষণ ছিল চীনের প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতের কোম্পানিগুলো
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী চীনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অধিকাংশই এসেছিলেন প্রযুক্তি, নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বস্ত্রশিল্প খাত থেকে। আলোচনায় উঠে আসে, বাংলাদেশের এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (EPZ), বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ), ও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)-এর মাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলো এখানে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
শানডং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের বাংলাদেশ প্রকল্পে ২০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস দেশের ৫জি নেটওয়ার্ক ও স্মার্ট সিটি প্রকল্পে অংশীদার হতে চায় বলে জানায়।
বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরা হয়
বাংলাদেশের তরুণ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমশক্তি, প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন খরচ, কর সুবিধা এবং সমুদ্রবন্দর ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিক তুলে ধরেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA)-এর প্রতিনিধিরা।
এছাড়া চীনকে প্রধান বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎস হিসেবে বিবেচনায় রেখে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানান পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য।
বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চীনসহ এশিয়ার বড় অর্থনীতিগুলোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎপাদন কেন্দ্র হতে চায়।
বাণিজ্য ভারসাম্য এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের বিষয়েও আলোচনা
সম্মেলনে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য ভারসাম্যের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়। বাংলাদেশ চায়, শুধু পণ্য আমদানির দিকেই না, বরং চীনা কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তি ও উৎপাদন সক্ষমতাও সরাসরি এদেশে আসুক।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাই চীনা কোম্পানিগুলো শুধু এখানে পণ্য রপ্তানির জন্য কারখানা স্থাপন করবে না, বরং স্থানীয় জনবলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমেও অবদান রাখবে।”
সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে চীন ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা এবং ভারতীয় প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ তার বহুমাত্রিক কূটনীতি আরও শক্তিশালী করছে। এর অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে কৌশলগত বিনিয়োগ সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর বাংলাদেশ-চীন অংশীদারিত্ব
চীন-বাংলাদেশ ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন করে উন্মোচিত হলো দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনার দ্বার। প্রধান উপদেষ্টার বিনিয়োগ আহ্বানের পর চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কারখানা, প্রযুক্তিকেন্দ্র, ও অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সম্মেলন শুধু বিনিয়োগ আহ্বান নয়, বরং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।