জাতীয়

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি মঙ্গলবার

একুশে আগস্ট, জাতির বুকে রক্তাক্ত এক দিন

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী এক শান্তিপূর্ণ জনসভায় ইতিহাসের ভয়াবহতম রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে চালানো এ গ্রেনেড হামলায় নিহত হন ২৪ জন, আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।

এই হামলার বিচার ও সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে দুই দশক ধরে চলছে চরম বিতর্ক, রাজনৈতিক উত্তাপ ও বিচারিক প্রক্রিয়া। সবচেয়ে আলোচিত এবং সংবেদনশীল মামলাগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত এই গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া আজও শেষ হয়নি।

হাইকোর্টে খালাস, আপিল বিভাগে নতুন শুনানি কাল

এই মামলার হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুটি আলাদা মামলায় হাইকোর্ট গত বছরের ১ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ আসামিকে খালাস দেন।

রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ‘লিভ টু আপিল’ (Leave to Appeal) দাখিল করে। আপিল বিভাগ আগামী মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫ তারিখে এই আপিলের শুনানির দিন নির্ধারণ করেছে।

আজ সোমবার (২৬ মে), বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ শুনানির জন্য আগামী দিন ধার্য করেন।

শুনানি পিছিয়ে গেল কেন?

আজকের কার্যতালিকায় রাষ্ট্রপক্ষের ‘লিভ টু আপিল’ দুইটি প্রথম ক্রমিকে ওঠে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অনুপস্থিত থাকায় শুনানি স্থগিত করা হয়।

আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এস. এম. শাহজাহান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, “আজ লিভ টু আপিল শোনার জন্য রাখা ছিল। প্রধান বিচারপতি অনুপস্থিত থাকায় আপিল বিভাগ আগামীকাল শুনানির দিন রেখেছে।”

রক্তাক্ত স্মৃতি: কারা হারিয়েছেন প্রাণ

২১ আগস্টের সেই ভয়াল দিনে নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান, এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতনি এবং আরও অনেক নেতাকর্মী। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও কানের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আহত হন দলের কেন্দ্রীয় নেতা, কর্মী, সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ। পরবর্তীতে অনেকেই সেই আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছেন আজও।

বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের বিপরীত রায়: ন্যায়বিচার কি নিশ্চিত হলো?

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।

কিন্তু হাইকোর্ট গত বছর (২০২৪) ডেথ রেফারেন্স, আপিল, জেল আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এই রায় বাতিল করে দেয়। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ তাদের যুক্তি দেখান, মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও সাক্ষীদের জবানবন্দি যথেষ্ট ছিল না।

রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরোধিতা করে পূর্ণাঙ্গ আপিলের অনুমতির আবেদন করে। গত ১৩ মার্চ চেম্বার আদালত আবেদন দুটি নিয়মিত বেঞ্চে পাঠান, যেগুলো আগামীকাল একসঙ্গে শুনানি হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায় ও আলোড়ন

২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৭৯ পৃষ্ঠার দুটি পৃথক মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে আইনজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

বিশেষ করে যারা এই হামলায় স্বজন হারিয়েছেন, তারা এই রায়কে চরম হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেন এবং নতুন করে তদন্ত ও বিচার দাবি জানান।

জনমত ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগ এবং ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এই রায়কে “বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি অসম্মান” বলে অভিহিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও একাধিকবার বলেন, “২১ আগস্টের হামলা ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হত্যাকাণ্ড। এর বিচার ইতিহাসের দায়।”

অন্যদিকে বিএনপি দাবি করেছে, আগের রায় ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হাইকোর্টে তারা ন্যায্য বিচার পেয়েছেন।

তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধান: এই মামলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

বিষয়তথ্য
হামলার তারিখ২১ আগস্ট ২০০৪
স্থানবঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা
নিহত২৪ জন
আহত৩০০+ (আনুমানিক)
অভিযোগপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় হামলা
বিচারিক রায়২০১৮ সালে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন
হাইকোর্ট রায়২০২৪ সালে সকল আসামি খালাস
আপিল শুনানি২৭ মে ২০২৫, আপিল বিভাগ

সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মতামত

অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা হাইকোর্টের রায় দেখে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা চাই সঠিক বিচার হোক এবং এই ভয়াবহ ঘটনার আসল হোতারা যেন শাস্তি পায়।”

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনেকে বলছেন, বিচার প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়।

নতুন তদন্তের দাবি বাড়ছে

আইন বিশেষজ্ঞরা এবং অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই মামলার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা নতুন তদন্ত কমিশন গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।

অনেকের দাবি, সিআইডির প্রথম তদন্ত ছিল ‘বানোয়াট’ এবং সেদিনের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

ন্যায়বিচারের পথে জাতির প্রতীক্ষা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, পুরো জাতিকে কাঁদিয়েছে। এর বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা।

আগামীকাল আপিল বিভাগে যেভাবে শুনানি পরিচালিত হয়, তা হতে পারে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পুরো জাতি তাকিয়ে আছে—এই শুনানি সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখাবে কিনা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button