বাংলাদেশ

গোপালগঞ্জে সংঘাত: নিহত চারজনের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন

গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে বুধবারের ভয়াবহ সংঘাতে প্রাণ হারানো চারজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, নিহতদের মরদেহ হাসপাতালে নিলেও সেখান থেকে পোস্টমর্টেম ছাড়াই জোরপূর্বক বাড়িতে নিয়ে যেতে বলা হয়। এখনো পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, তদন্তের গতি নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

কী ঘটেছিল গোপালগঞ্জে?

গত বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘোষিত ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ শহরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এনসিপির কর্মসূচিতে বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায়।

এ সময় গুলিতে ঘটনাস্থলেই চারজন প্রাণ হারান এবং অন্তত ৩০ জন আহত হন। সংঘাতের পর গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয় এবং বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তা বহাল থাকে।

নিহতদের পরিচয় ও দাফনের ঘটনা

সংঘাতে নিহত চার ব্যক্তি হলেন:

  • রমজান কাজী (৩৮), পেশায় রাজমিস্ত্রি, গ্রামের বাড়ি হরিণাহাটি, কোটালীপাড়া
  • সোহেল রানা (৩২), মোবাইল পার্টস ব্যবসায়ী, পূর্ব মিয়াপাড়া
  • দীপ্ত সাহা (২৯), পোশাক ব্যবসায়ী, উদয়ন রোড
  • ইমন তালুকদার (২৬), দোকান কর্মচারী, ভেড়ার বাজার

চারজনই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য। কিন্তু সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো—তাদের কারোর মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি।

ময়নাতদন্ত না হওয়া নিয়ে যা জানা গেছে

নিহতদের মরদেহ প্রথমে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে পরিবারের লোকদের বলা হয় “সমস্যা হতে পারে, লাশ বাড়ি নিয়ে যান।” ফলে কোনো ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই লাশ দাফন ও সৎকার করা হয়।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “চারজনের মৃতদেহ হাসপাতালে এসেছিল, তবে ময়নাতদন্ত করা হয়নি।”

একই সঙ্গে পুলিশও সুরতহাল রিপোর্ট দেয়নি এবং কোনো মৃত্যুসনদও ইস্যু করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে নিহতদের পরিবার।

পরিবারের বক্তব্য

নিহত রমজান কাজীর মামা কলিম মুন্সি বলেন, “হাসপাতালে নিলে বলা হয় থানায় নিয়ে যান। থানার গেট বন্ধ পেয়ে ফের হাসপাতালে যাই, তখন তারা জানায়, সমস্যা হতে পারে, লাশ বাড়ি নিয়ে যান।”

নিহত সোহেল রানার মামা জাহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়ি নিয়ে আসা হয়, কোনো পোস্টমর্টেম বা ডেথ সার্টিফিকেট কিছুই দেওয়া হয়নি।”

এই অবস্থায় পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক, ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

প্রশাসনের ভূমিকা ও ব্যাখ্যা

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “এখন পর্যন্ত ২৫ জনের অধিককে আটক করা হয়েছে।” তবে ময়নাতদন্ত না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে বলেন, “বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হবে।”

একই সঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “উচ্ছৃঙ্খল জনতা হাসপাতাল থেকে মরদেহ জোরপূর্বক নিয়ে গেছে বলে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।”

তবে স্থানীয়দের বক্তব্য, পুলিশের উপস্থিতিতে এমনটি হলে প্রশাসনের দায়িত্ব আরও বেশি ছিল। অথচ কোনো সংরক্ষিত ভিডিও ফুটেজ বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়নি।

কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল ময়নাতদন্ত?

আইন অনুযায়ী, যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম অপরিহার্য। এটি শুধু মৃত্যুর কারণ নয়, বরং ঘটনাটির প্রকৃতি ও দায়ীদের শনাক্ত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে এই ধরনের সংঘাতে মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত না হওয়া বিষয়টিকে অনেকেই গোপন তথ্য আড়াল করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, “ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন হলে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু তদন্তের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এটি সংবিধান ও ফৌজদারি আইনের পরিপন্থী।”

স্থানীয় প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক উত্তাপ

স্থানীয়ভাবে এই ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই মনে করছেন, প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনা আড়াল করতে চাইছে। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “সরকারপ্রধানের জেলা বলেই প্রশাসন অন্ধ ভূমিকা নিচ্ছে। নাহলে চারটি লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন কীভাবে হয়?”

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে দাবি করছে।

ভবিষ্যৎ তদন্ত ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ

এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের পরিবারের কিছু সদস্য ও স্থানীয়রা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হতে পারে বলেও সূত্র জানায়।

স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত বিচার ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

শেষ কথা

গোপালগঞ্জের এই সংঘাত এবং তার পরবর্তী ঘটনা বাংলাদেশের আইন ও মানবাধিকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়া চারজনের দাফন শুধু আইনগত প্রশ্নই তোলে না, বরং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার দিকেও আঙুল তোলে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেবে, তা নির্ভর করছে প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার সদিচ্ছার ওপর।

এম আর এম – ০৩৯৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button