কাপ্তাই বাঁধের সব জলকপাট খোলা: কর্ণফুলী নদীতে বিপৎসীমার পানি মুক্তি

পাহাড়ি ঢলের কারণে কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট (গেট) খুলে দেওয়া হয়েছে। টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে হ্রদের পানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সোমবার রাত ১২টা ২ মিনিটে গেট খুলে পানি নিঃসরণ শুরু করা হয়।
কাপ্তাই বাঁধের গুরুত্ব ও অবস্থা
কাপ্তাই বাঁধ বাংলাদেশের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত। এটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, বাঁধটি কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষা ও স্থানীয় কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, ‘১৬টি গেট থেকে প্রতি গেটে ৬ ইঞ্চি করে পানি ছাড়ার মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৯,০০০ কিউসেক পানি হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশিত হচ্ছে।’ এর ফলে হ্রদের পানি নিয়ন্ত্রণে আসছে এবং বাঁধের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে।
কেন এত জরুরি ছিল গেট খোলা?
কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমা হিসেবে নির্ধারিত আছে ১০৮ ফুট। এর বেশি পানি জমলে বাঁধের ওপর চাপ বাড়ে যা বিপজ্জনক। হ্রদের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ১০৯ ফুট হলেও বর্তমানে পানি বেড়ে ১০৮.৫ ফুটে পৌঁছে গিয়েছিল। এর ফলে বাঁধে চাপ তৈরি হওয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, মূলত আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সব গেট খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, তবে রাতেই হঠাৎ করে পানি বেড়ে যাওয়ায় আগেভাগে গেট খোলা হয়। এতে করে অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিকাশিত হচ্ছে এবং বাঁধের নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে পানি নিয়ন্ত্রণ
কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্রিয় রয়েছে, যার মাধ্যমে ৩২,০০০ কিউসেক পানি হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন চলাকালে এই পানি নিষ্কাশন বাঁধের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করছে।
বিভিন্ন সময়ে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশের জলসম্পদের ওপর বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এর মধ্যে কাপ্তাই বাঁধের গুরুত্ব ও দায়িত্ব আরও বেড়ে যায় কারণ এটি দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কড়ি।
কাপ্তাই বাঁধ ও কর্ণফুলী নদীর ভূগোল ও পরিবেশ
কাপ্তাই বাঁধ রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত। এটি কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এবং বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাঁধটি ১৯৬২ সালে নির্মিত হয় এবং এটি প্রায় ১,১৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষম।
বাঁধের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদ তৈরি হয়, যা বাংলাদেশের বৃহত্তম জলাভূমি এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে হ্রদের পানি পর্যায়ক্রমে ওঠানামা করে থাকে।
কেন বাড়ে কাপ্তাই হ্রদের পানি?
প্রতিবছর বর্ষাকালে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে কাপ্তাই হ্রদে। ২০২৫ সালের এই বর্ষাকালে দীর্ঘদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের প্রবলতায় হ্রদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। যেহেতু পানি ধারণক্ষমতার সীমা রয়েছে, তাই অতিরিক্ত পানি মুক্তির জন্য জলকপাট খোলা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
কাপ্তাই বাঁধ খোলার প্রভাব ও পরবর্তী করণীয়
জলকপাট খোলার ফলে কর্ণফুলী নদীতে প্রচুর পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যা নদীর নাব্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিম্নাঞ্চল ও আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্য স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড অতিরিক্ত সতর্কতা নিয়েছে।
নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদেরকে অতি প্রয়োজন ছাড়া নদীর কাছাকাছি যেতে নিষেধ করা হয়েছে এবং সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বন্যা মোকাবিলায় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কাপ্তাই বাঁধ: ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
কাপ্তাই বাঁধ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি রোল মডেল হলেও, জলবায়ু পরিবর্তন ও পাহাড়ি ঢলের বৃদ্ধি এই বাঁধের নিরাপত্তায় নতুন চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাঁধের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে, যাতে অতিরিক্ত পানি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সেই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষা, পানির গুণগত মান বজায় রাখা এবং আশেপাশের বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি।
বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র কাপ্তাই বাঁধে এই খোলা গেটের মাধ্যমে জলস্তর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়তে থাকা বন্যার ঝুঁকি সামাল দেয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় প্রশাসন, কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড একযোগে কাজ করে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে কাজ করছে।
MAH – 12135, Signalbd.com