২ জুন বাজেট পেশ করবে অন্তর্বর্তী সরকার

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী ২ জুন, সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাজেট ঘোষণা করা হবে। দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এটা এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত, কারণ সাধারণত জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ থাকলেও এবারে সেই প্রথা থেকে সরে এসে ঈদুল আজহার পূর্বপ্রস্তুতি মাথায় রেখে আগেভাগেই বাজেট ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির যৌথ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আসন্ন ঈদ উৎসবকে নির্বিঘ্ন রাখতে বাজেট ঘোষণার তারিখে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বাজেটের আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, নতুন বাজেটে ৭ হাজার কোটি টাকা কমে আসছে। অর্থ উপদেষ্টা এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছেন যে, আর্থিক সংযমের নীতিমালা অনুসরণ করেই বাজেট প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাজেটের আকার সীমিত রাখা প্রয়োজন। রাজস্ব আয়, বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ—সবকিছুর উপর নির্ভর করে দেশের ব্যয় সামঞ্জস্য করতে হবে। এই কারণে এবারের বাজেটের আকার তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হচ্ছে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বড় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ধরে রাখাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর আকারও কিছুটা কমানো হচ্ছে। তবে যেসব মেগা প্রকল্প চলছে, সেগুলোর অর্থায়ন অব্যাহত থাকবে।
বাজেট ঘোষণা ও সংসদীয় প্রক্রিয়া
জাতীয় সংসদ বর্তমানে বিলুপ্ত থাকায় এবারের বাজেট ঘোষণা হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে বাজেট পেশের পরিবর্তে আগামী ২ জুন টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করবেন। বাজেট ঘোষণার পরদিন অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করবে। সেখানে বাজেটের বিস্তারিত দিক এবং সরকারের রাজস্ব ও ব্যয় কাঠামো নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন অর্থ উপদেষ্টা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট রাজনৈতিক চাপের বাইরে থেকে বাস্তবসম্মত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ নতুন কোনো সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং রাজস্ব ও ব্যয়ের ভারসাম্য সংরক্ষণে এই বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে, এনবিআরের বড় চ্যালেঞ্জ
প্রতিবারের মতো এবারের বাজেটেও রাজস্ব আদায়ের প্রধান ভরসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের জন্য ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। যা চলতি অর্থবছরের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার তুলনায় প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এনবিআরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রশাসনিক সংস্কার, করপোরেট কর নীতিতে পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতি আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থ বিশেষজ্ঞদের মতে, করপোরেট কর নীতির যৌক্তিক সংস্কার, কালো টাকার বৈধীকরণে কঠোর অবস্থান এবং ভ্যাটের পরিসীমা আরও বিস্তৃত করা ছাড়া এই উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
অর্থনৈতিক সংকট ও বাজেট কাঠামোর সমন্বয়
বর্তমান বৈশ্বিক মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, রপ্তানি আয়ের নিম্নগতি এবং আমদানির চাপ সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকার সংযমী বাজেটের পথে হাঁটছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে বারবার বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ সংকট এবং বর্ধিত আমদানি ব্যয়ের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাজেট কাঠামোতে ব্যয় সংকোচন এবং আয়ের দিক শক্তিশালী করাই এই বাজেটের মূল লক্ষ্য। সামাজিক নিরাপত্তা খাত, কৃষি খাত, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ ঠিক রাখা হবে বলে জানা গেছে। তবে এই বরাদ্দের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বর্জন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
নতুন বাজেট ও জন-প্রত্যাশা
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট জনমুখী এবং আর্থিক শৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দেবে। বড় ধরনের মেগা প্রকল্প বাদ দিয়ে মূলত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় এবং রুটিন উন্নয়ন ব্যয়ই প্রাধান্য পাবে এই বাজেটে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট পেশ দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় স্বচ্ছতা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও চাইছেন, বাজেটে এমন প্রণোদনা প্যাকেজ রাখা হোক যা উৎপাদন খাতকে চাঙ্গা করবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
শেষ কথা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মঞ্চ। জাতীয় রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সুষম উন্নয়নের সংমিশ্রণেই এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা এবং সুসংগঠিত রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর ভর করেই অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট দেশের অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে। এবারের বাজেট, প্রথার বাইরে গিয়েও, দেশের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।