এয়ার ইন্ডিয়া উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা তদন্তে কণ্ঠস্বর রহস্য

ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ শহরে ঘটে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পরেও রহস্য ও প্রশ্ন উঠে গেছে। গত মাসে ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনায় ২৬০ জন যাত্রী ও কর্মী প্রাণ হারান। কিন্তু তদন্তের রিপোর্টের কিছু তথ্যের কারণে বিষয়টি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
১. দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০২৫ সালের জুন মাসে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের বিখ্যাত বি জে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ওপর আছড়ে পড়ে একটি ১২ বছরের পুরোনো বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজ। উড়োজাহাজটিতে ২৪২ জন যাত্রী এবং ক্রু সদস্য ছিলেন। বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই তীব্র আগুন লেগে যায়। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস দ্রুত আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি হয়।
২. প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের মূল তথ্য
ভারতীয় দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদনে উড়োজাহাজের ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের (সিভিআর) সংক্ষিপ্ত একটি অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই ভয়েস রেকর্ডিং থেকে জানা গেছে, বিমান উড়ানোর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্বালানি সরবরাহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুইচ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
সুইচ বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে দুই বিমানচালকের মধ্যে কথাবার্তা চলে, যেখানে একজন প্রশ্ন করছেন, ‘তুমি কেন সুইচগুলো বন্ধ করেছ?’ এবং অন্যজন উত্তর দিচ্ছেন, ‘আমি তো বন্ধ করিনি।’ কিন্তু ভয়েস রেকর্ডিং থেকে ঠিক কোন পাইলট কার কথা বলছেন, তা পরিষ্কার হয়নি।
এ সময় সহবিমানচালক উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, আর ক্যাপ্টেন তদারক করছিলেন। ইঞ্জিনের একটি সুইচ পরবর্তীতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়, কিন্তু অপরটি চালু হয়নি। ফলে, উড়োজাহাজটি মাত্র এক মিনিটের কম সময় আকাশে থাকার পর গুজরাটের একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
৩. ককপিট ভয়েস রেকর্ডার ও জল্পনা
এএআইবি পুরো সিভিআর ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করেনি, শুধুমাত্র দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে অনেকেই সন্দেহ করছেন, পুরো সত্যিটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম যেমন ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’, ‘রয়টার্স’ এবং ইতালির ‘করিয়েরে দেলা সেরা’ দাবি করেছে, যে সহবিমানচালক বারবার ক্যাপ্টেনকে প্রশ্ন করেছেন কেন তিনি ইঞ্জিন বন্ধ করেছেন। এই তথ্য উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের রহস্য আরও জটিল করে তুলেছে।
৪. বিমানচালকদের অভিজ্ঞতা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা
দুর্ঘটনাস্থলে থাকা ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন সুমিত সভারওয়াল (৫৬ বছর) এবং সহবিমানচালক ক্লাইভ কুণ্ডার (৩২ বছর)। দুজনের অভিজ্ঞতা ১৯ হাজার ঘণ্টারও বেশি, যার অর্ধেক বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজে। উড়োজাহাজ চালানোর পূর্বে উভয়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
৫. ভারতীয় পাইলটদের প্রতিক্রিয়া এবং তদন্ত সংস্থার প্রতিউত্তর
ভারতীয় পাইলটদের সংগঠনগুলি এই মুহূর্তে চালু কিছু অনুমান এবং তথ্য ফাঁসকে গুরুতর উদ্বেগের বিষয় মনে করছে। ইন্ডিয়ান কমার্শিয়াল পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন (ICPA) এই ধরনের তড়িঘড়ি এবং ভিত্তিহীন অভিযোগকে “অত্যন্ত অসংবেদনশীল” বলে অভিহিত করেছে।
দুর্ঘটনার তদন্ত সংস্থা এএআইবি জানিয়েছে, এখনও তদন্ত চলছে এবং অবাস্তব তথ্য ভিত্তিক প্রচারণা তদন্তকে বিঘ্নিত করছে। এএআইবি’র মুখপাত্র জানান, “তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অনুমান না করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
৬. আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার গোয়েলজ বলেছেন, “ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের পুরো ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করা জরুরি, যাতে পাইলটদের কণ্ঠস্বর সনাক্ত করা যায়।”
তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, যেকোন যান্ত্রিক সমস্যা ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (এফডিআর) এ ধরা পড়ে এবং পাইলটরা সেটি মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ ও আলোচনার বিষয় করে থাকেন। তাই তদন্তের শেষ প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন।
৭. বিভিন্ন সম্ভাব্য কারণ ও তত্ত্ব
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে নানা মত প্রকাশ করেছেন:
- ককপিটে যান্ত্রিক ত্রুটি বা পাইলটের ভুল: জ্বালানি সরবরাহ সুইচগুলি বন্ধ করার বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকার কারণে পাইলটের অসতর্কতা বা ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে।
- ডিজিটাল ইঞ্জিন কন্ট্রোল (FDEC) ত্রুটি: কিছু বিমানচালক মনে করেন, বোয়িং ৭৮৭-এর এফএডিইসি সিস্টেমে ত্রুটি ঘটলে ইঞ্জিন নিজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- উড়োজাহাজের লেজে আগুন: ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, লেজে বৈদ্যুতিক আগুনের সূত্র ধরে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- বিমান চালক বা সহপাইলটের জড়িত থাকার সম্ভাবনা: কানাডাভিত্তিক একটি তদন্তকারী বলেছেন, হয়তো কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই সুইচগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে অস্বীকার করেছেন।
৮. ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার ও জনমত
দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনরা আজও শোকাহত। গুজরাট শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে নিহতদের পরিবারের আহাজারি, বিচার দাবি ও ক্ষতিপূরণের দাবী উঠেছে।
সাধারণ মানুষ এবং সংবাদ মাধ্যমও তদন্তের স্বচ্ছতা ও সত্য উদঘাটনের জন্য চাপ দিচ্ছে। অনেকেই উদ্বিগ্ন, যে পূর্ণ সত্য প্রকাশ না হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানো কঠিন হবে।
৯. আগামী পথ এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন
ভারতের দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) জানিয়েছে, চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অন্তত এক বছর সময় লাগতে পারে। এই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ, দায়ীদের শনাক্তকরণ এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধের সুপারিশ থাকবে।
১০. উপসংহার: সতর্কতা ও অপেক্ষার আহ্বান
এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুবই বিপজ্জনক।
বিশেষজ্ঞরা এবং তদন্তকারীরা সবাই বলছেন, পাইলটদের দোষারোপ করার আগে পুরো তদন্ত শেষ হওয়া জরুরি। সুস্পষ্ট প্রমাণ ও প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতেই সমাধান আনা উচিত।