মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদে বাবাকে খুন: রাজশাহীতে প্রধান আসামিসহ গ্রেপ্তার ৩

রাজশাহীতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করেছিলেন এক বাবা। আর তাতেই তাঁকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো। ঘটনাটি গত বুধবার রাতে ঘটে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি নান্টুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখন চলছে আইনি প্রক্রিয়া, তবে সমাজে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে— আমরা কবে উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব?
ঘটনা যেভাবে unfolded
রাজশাহী নগরের তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকার বাসিন্দা বাসচালক আকরাম আলী (৪৫) ছিলেন একজন সৎ ও দায়িত্ববান বাবা। তাঁর মেয়ে রাফিয়া আলফি, এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছিল একই এলাকার যুবক মো. নান্টু ও তার সহযোগীরা।
গত বুধবার রাতে, মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গেলে আকরাম আলী ও তাঁর ছেলে ইমাম হাসান মারধরের শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে, সেখানেই আকরাম আলী মারা যান।
হৃদয়বিদারক বিষয় হলো— বাবার লাশ রেখে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিল রাফিয়াকে। এ ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও আলোচনার জন্ম দেয়।
র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ৩ জন
র্যাব-৫ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতে নওগাঁ সদর থানার আড়ারাপাড়া গ্রামে অভিযান চালায়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মামলার প্রধান আসামি মো. নান্টু (২৮) ও তার অন্যতম সহযোগী খোকন মিয়া (২৮)-কে। একইদিন বিকেলে গ্রেপ্তার করা হয় নান্টুর আরেক সহযোগী রুমেল (২৫)-কে।
শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে, র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ বলেন:
“নান্টু ও খোকন ঘটনার পর একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।”
গ্রেপ্তারকৃতদের বোয়ালিয়া মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান র্যাব কর্মকর্তা।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য
পুলিশ ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসএসসি পরীক্ষার্থী রাফিয়া আলফি গত কয়েক মাস ধরেই নান্টু গ্যাং-এর দ্বারা উত্ত্যক্ত হচ্ছিলেন। বিভিন্ন সময় অশ্লীল মন্তব্য, হুমকি ও শারীরিকভাবে হয়রানি করার মতো ঘটনা ঘটেছে।
অবশেষে মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে সরাসরি প্রতিবাদ করেন বাবা আকরাম আলী। কিন্তু এই প্রতিবাদই তাঁর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মামলার বিবরণ
বৃহস্পতিবার আকরামের ছেলে ইমাম হাসান বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়।
এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন:
- মো. নান্টু (২৮)
- মো. বিশাল (২৮)
- খোকন মিয়া (২৮)
- তাসিন হোসেন (২৫)
- মো. অমি (২০)
- মো. নাহিদ (২৫)
- মো. শিশির (২০)
এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই আগে থেকেই একাধিক অপরাধমূলক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
বাবার লাশ রেখে পরীক্ষাকেন্দ্রে মেয়ের উপস্থিতি
এই ঘটনার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অংশ হলো, হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরদিন বৃহস্পতিবার, এসএসসি পরীক্ষার একটি বিষয়ের পরীক্ষা ছিল রাফিয়ার। বাবার লাশ ঘরে রেখে সে সময়মতো পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হয়।
এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বহু শিক্ষার্থী ও নাগরিক মিছিল, মানববন্ধনের মাধ্যমে রাফিয়ার প্রতি সহমর্মিতা জানায় এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলে।
রাজশাহীতে মানববন্ধন ও বিচার দাবিতে আন্দোলন
ঘটনার প্রতিবাদে রাজশাহী শহরে বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় বাসিন্দারা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। তাঁরা বলেন:
“আজ একজন বাবা মেয়ের জন্য প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন, কাল হয়তো আরও কারও বাবা, ভাই বা সন্তান এভাবে প্রাণ হারাবে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।”
বিচার দাবিতে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও নারী নির্যাতনের বাস্তবতা
এই ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল— দেশের শহরাঞ্চলেও নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ নেই বললেই চলে। অনেক সময় পরিবার নিরুপায় হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইভ টিজিং’ বা উত্ত্যক্ত করা অনেক সময় ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। শুধুমাত্র আইনি শাস্তি নয়, দরকার সচেতনতা, শিক্ষা ও পারিবারিক সহায়তা।
পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বাস
রাজশাহী মহানগর পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মামলার তদন্ত চলছে দ্রুতগতিতে। বাকি আসামিদেরও খুব দ্রুত গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
রাজশাহীতে মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করে প্রাণ হারানো আকরাম আলীর এই ঘটনা সমাজে এক গভীর প্রশ্ন তুলেছে— নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য আমরা আর কত প্রাণ দেব? একজন বাবা তাঁর কন্যার নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, আর তাতেই তাঁকে খুন হতে হলো।
এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের এক নির্মম চিত্র। সময় এসেছে আইন, প্রশাসন, পরিবার ও সমাজ—সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসার।