অর্থনীতি

অনুমতি পৌনে ১৭ লাখ টন, চাল আমদানি ৫ লাখ ৪০ হাজার

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দেশের চালের বাজারে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও, চাল আমদানিতে যথাযথ গতি না আসার কারণে বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছর সরকারের বেসরকারি খাতে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ৬৮ শতাংশ চাল এখনো আমদানি করা হয়নি। দীর্ঘ সময়সীমা বাড়ানোর পরও আমদানি লক্ষ্য পূরণ হয়নি এবং এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম ২ শতাংশ বেড়ে ৫০-৫৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

অন্তত ৬৮ শতাংশ চাল আমদানি হয়নি

২০১৯ সালের নভেম্বরে খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বেসরকারি খাতের জন্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মোট ২৭৭টি বরাদ্দপত্রের মাধ্যমে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে শুরুতে চার দফায় সময়সীমা বাড়ানোর পরও একাধিক ব্যবসায়ী যথাযথভাবে আমদানি করেননি। মাত্র এক লাখ টন চাল আমদানি হয়, যা অনুমতির মাত্র ৭ শতাংশ।

এরপরও পরিস্থিতি উন্নতির পথে ছিল না। মে মাসের বোরো মৌসুমের পূর্বে চাল আমদানির সময়সীমা পুনরায় বাড়ানো হয়, কিন্তু বিভিন্ন কারণে পুরো আমদানির পরিমাণ এখনও লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি।

মোটা চালের দাম বৃদ্ধি: কীভাবে সামলাবে সরকার?

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম ২ শতাংশ বেড়েছে, যা গত মাসে ৫০-৫৫ টাকার মধ্যে ছিল, তা এখন ৫০-৫৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায়, সরকারের দায়িত্ব রয়েছে সঠিক সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়ার।

ময়মনসিংহের কৃষিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, যিনি সিপিডির গবেষণা পরিচালক, তিনি জানান, ‘‘এখনই বোরো মৌসুমের ফসল বাজারে আসবে, যার ফলে চালের বাজারে একটি স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে আমদানি সময়সীমা বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।’’

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগে চালের দাম বৃদ্ধির পূর্বাভাস

২০২৫ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (USDA) এক প্রতিবেদনে জানায়, এ বছরের এপ্রিলের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চালের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি বিভাগ আশা করছে, মে মাসে বোরো ফসল বাজারে আসার পর চালের দাম কিছুটা কমতে পারে। তবে উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে আগস্ট থেকে চালের দাম আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে।

সরকারি আমদানির উদ্যোগ

এবার সরকারের পক্ষ থেকে আরও একবার বাজারে চালের চাহিদা মেটানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গত আগস্টে বন্যার কারণে দেশের চাল উৎপাদন কমে গেলে, সরকার চালের মজুত বাড়ানোর লক্ষ্যে ৯ লাখ টন চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে, এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি খাত থেকে ৬ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। জাতীয় খাদ্য গুদামে সরকারের মজুত বর্তমানে ৯ লাখ ২৭ হাজার টন রয়েছে। এর ফলে, বাজারে চালের নিরাপত্তা মজুত বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে এবং মজুতের পরিমাণ আগামী মাসে আরও বাড়তে পারে।

চালের বাজারে পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবে সরকার?

খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান সম্প্রতি জানিয়েছেন, বর্তমানে সরকারি মজুত ১০ লাখ টনের আশপাশে রয়েছে এবং চালের মজুত নিয়ে কোনো আতঙ্কের কারণ নেই। তিনি আরও বলেন, ‘‘আমদানির পাশাপাশি বোরো মৌসুমের ফসল সংগ্রহ শুরু হবে, ফলে বাজারে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না।’’

এখনো বেসরকারি আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা

দেশে প্রতি বছর চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেসরকারি খাতের আমদানির সুযোগ দীর্ঘায়িত করা উচিত, যাতে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘‘বর্তমানে দেশের মধ্যে প্রতিদিন এক লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। যদি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে দাম আরও বাড়তে পারে, যা দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য দুর্বিসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।’’

চাল বাজারে সংকট বা স্থিতিশীলতা?

অবশ্য, বেসরকারি আমদানির সীমাবদ্ধতা থাকলেও, চট্টগ্রামের আফসানা ট্রেডিং এবং মক্কা ট্রেডার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কম আমদানির পরও চালের বাজারে খুব বেশি সংকট সৃষ্টি হয়নি। আফসানা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার ওমর আজম জানান, ‘‘বর্তমানে আমদানি না করলেও, বাজারে চালের অভাব নেই। মধ্যস্বত্বভোগীরা ধানের দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না।’’

মক্কা ট্রেডার্সের মালিক মহিউদ্দিন আহমেদ বেলাল জানান, ‘‘বেসরকারি খাতের চাল আমদানি কম হলেও, যারা চাল আমদানি করেছেন, তারা সেগুলো নামমাত্র লাভে বিক্রি করেছেন। নতুন প্রতিষ্ঠানেরা সেইভাবে আমদানি করতে পারেনি।’’

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

এখনো বোরো মৌসুমের ফসল মাঠে ওঠেনি, এবং তা বাজারে আসার পর চালের দাম কিছুটা কমতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা অনেকটা বেড়ে গেছে, এবং দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সঠিক সময়ে চালের সরবরাহ বজায় রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রাখা জরুরি।

সরকারের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে, বাজার পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক করতে এবং কৃষকদের স্বার্থে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button