খেলাক্রিকেট

হৃদয়কে খেলাতে ডিপিএলের নিয়মই বদলে ফেললো বিসিবি

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) চলতি মৌসুমে এমন এক ঘটনা ঘটেছে যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের শৃঙ্খলা ও নীতিনৈতিকতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। মোহামেডানের অধিনায়ক তাওহীদ হৃদয়কে খেলানোর জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়মকানুনের ভিত্তিকে রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছে।

তাওহীদ হৃদয়কে ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সুপার লিগের ম্যাচে খেলানোর জন্য বিসিবি রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলেছে ডিপিএলের বাই লজ, অর্থাৎ খেলোয়াড়দের জন্য নির্ধারিত আচরণ বিধি ও শাস্তির নিয়ম। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যেমন ক্রিকেট অঙ্গনে বিস্ময় তৈরি হয়েছে, তেমনি উঠেছে অনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ।

ডিমেরিট পয়েন্ট ও নিষেধাজ্ঞা: ঘটনার সূত্রপাত

ঘটনার শুরু আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে তাওহীদ হৃদয়ের অশোভন আচরণ থেকে। ম্যাচ চলাকালে আম্পায়ারের প্রতি অবমাননাকর ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি, যার ফলে তার নামে যুক্ত হয় ৪ ডিমেরিট পয়েন্ট। পরবর্তীতে সেই বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করায় যুক্ত হয় আরও ৩ পয়েন্ট। ফলে মোট ৭ ডিমেরিট পয়েন্টের ভিত্তিতে তাকে ২ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।

ডিপিএলের ৭.৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে—৪ থেকে ৭ ডিমেরিট পয়েন্ট প্রাপ্ত খেলোয়াড়কে ২ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও অর্থদণ্ডের মুখে পড়তে হবে। সেই ধারায়ই তাওহীদ হৃদয়কে শাস্তি দেয় টেকনিক্যাল কমিটি।

আবেদনের ফল: শাস্তির আংশিক মওকুফ

তাওহীদ হৃদয়ের পক্ষ থেকে শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। সেই আপিলের প্রেক্ষিতে আর্থিক জরিমানা মওকুফ করা হলেও নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। অর্থাৎ, নিয়মানুযায়ী, হৃদয়ের রোববারের ম্যাচে খেলার সুযোগ ছিল না।

কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষের চাপে বিসিবি অপ্রত্যাশিতভাবে নিয়ম বদলে ফেলে, যাতে হৃদয় ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই সিদ্ধান্তে প্রশ্ন উঠে যায়, খেলাধুলায় শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা আদৌ বজায় আছে কি না।

নিয়ম পরিবর্তনের নাটকীয়তা

সুপার লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের দিন বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটি থেকে একটি মেমো পাঠানো হয় সিসিডিএম-এ (ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস)। সেখানে বলা হয়, ৭.৫ ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং এখন থেকে ৪ থেকে ৭ ডিমেরিট পয়েন্টের জন্য শাস্তি হবে মাত্র ১ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা।

এই পরিবর্তনের কোনও পূর্ব ঘোষণা ছিল না, এমনকি টেকনিক্যাল কমিটির সাথেও কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে। এমনকি টেকনিক্যাল কমিটির পক্ষ থেকেও শাস্তি কমানোর কোনও সুপারিশ করা হয়নি।

ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের হঠাৎ নিয়ম পরিবর্তন গভীর দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয় এবং এটি কেবল নির্দিষ্ট এক খেলোয়াড় বা ক্লাবের পক্ষ নেয়ার ইঙ্গিত নয়—বরং পুরো লিগের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এনামুল হক মনির পদত্যাগ: নীরব প্রতিবাদ

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান এনামুল হক মনি তার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। যদিও তিনি তার পদত্যাগের পেছনে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ ও ‘কাজের চাপ’ উল্লেখ করেছেন, তবে অভ্যন্তরীণ সূত্র ও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ।

টেকনিক্যাল কমিটির মতামত উপেক্ষা করে নিয়ম বদলের ঘটনা মনি সহজভাবে নিতে পারেননি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তিনি নিজেই ছিলেন হৃদয়ের শাস্তির পক্ষে, যা পরে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বদলে যায়। এটাই তার পদত্যাগের মূল কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই।

শিরোপার লড়াইয়ে মোহামেডানের অবস্থান

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ডিপিএলের সুপার লিগ পর্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। শিরোপা দৌড়ে টিকে থাকার জন্য দলের সেরা ব্যাটসম্যান তাওহীদ হৃদয়ের উপস্থিতি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, এই কারণে ক্লাবের চাপে পড়ে বিসিবি এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো দলের স্বার্থে কীভাবে এমন নীতি বহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? কেবল একজন খেলোয়াড়কে খেলানোর জন্য কৌশলে পুরো বাই লজ বদলে ফেলা—এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং প্রফেশনালিজমকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ক্রিকেট অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া

ক্রিকেট বিশ্লেষক, সাবেক খেলোয়াড় ও ভক্ত-সমর্থকদের মধ্যে এই ঘটনাটি নিয়ে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন টকশোতেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হৃদয়কে খেলানোর জন্য নিয়ম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাধুলায় শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে এভাবে নিয়ম ভাঙা হয়, তবে ভবিষ্যতে এই উদাহরণকে কেন্দ্র করে আরও বড় ধরনের দুর্নীতি ও পক্ষপাতের ঘটনা ঘটতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button