যেভাবে আর্জেন্টিনার মার্তিনেজকে ময়মনসিংহে ফেরালেন শ্রাবণ

ফেডারেশন কাপ ফাইনাল মানেই বাড়তি উত্তেজনা, বাড়তি চাপ এবং একজোড়া চোখ মাঠজুড়ে, যারা মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য। ময়মনসিংহ জেলা স্টেডিয়ামে বসুন্ধরা কিংস বনাম আবাহনীর এই ফাইনাল ম্যাচটিও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সমতা পূর্ণ ৯০ মিনিট শেষে টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচের নায়ক হয়ে উঠলেন বসুন্ধরা কিংসের তরুণ গোলরক্ষক মেহেদী হাসান শ্রাবণ। পেনাল্টি ঠেকানোর পর উদযাপন করে তিনি যেন ফিরিয়ে আনলেন কাতার বিশ্বকাপের মার্তিনেজকে!
টানটান উত্তেজনার ফাইনাল ও টাইব্রেকারের রোমাঞ্চ
খেলার ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে দুই দলই চেষ্টা করেছিল গোলের জন্য। কিন্তু খেলার ফলাফল দাঁড়ায় ১-১ গোলে। ফেডারেশন কাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। আর এই শ্যুটআউটেই ভাগ্য বদলের মহানায়ক হয়ে ওঠেন শ্রাবণ।
আবাহনীর নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড এমেকা ওগবাহর পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে শ্রাবণ এনে দেন কিংসের শিরোপা। এরপরই তাঁর উদযাপন ফুটবলপ্রেমীদের মনে করিয়ে দেয় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে।
মার্তিনেজের ছায়া হয়ে উঠলেন শ্রাবণ
পেনাল্টি ঠেকানোর পর শ্রাবণের নাচ ও উদযাপন ছিল প্রায় হুবহু মার্তিনেজের মতো। কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে একের পর এক সেভ করে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন মার্তিনেজ। সেদিন যেমন গোটা ফুটবল দুনিয়া বিস্মিত হয়েছিল তাঁর সাহস ও উদযাপনে, তেমনই গতকাল বাংলাদেশের মাঠেও ফুটে উঠল তেমন এক দৃশ্য।
শ্রাবণ নিজেই স্বীকার করেছেন মার্তিনেজ তাঁর আদর্শ। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ম্যাচ-সেরা হয়ে আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “পেনাল্টি ঠেকানোর পর তাৎক্ষণিকভাবে মার্তিনেজের কথা মনে পড়ে যায়। তিনিও তো এভাবে উদযাপন করেছিলেন। আমি ইউটিউবে মার্তিনেজের ভিডিও দেখি, তাঁকে অনুসরণ করি। আর্জেন্টিনা আমার প্রিয় দল।”
সমালোচনার জবাব মাঠেই দিয়েছেন
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলে ফাহামিদুল ইসলামের না থাকা নিয়ে অনেকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন শ্রাবণের দিকে। যদিও এই গুজবের কোনো ভিত্তি মেলেনি, তারপরও সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাঁকে। কিন্তু শ্রাবণ সেসব সমালোচনায় কান না দিয়ে পরিশ্রমে মন দেন এবং তার প্রমাণ মিলল ফাইনালে।
কঠিন সময় পার করেও বসুন্ধরা কিংসের এই ১৯ বছর বয়সী তরুণ গোলরক্ষক মাঠে নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিলেন। শুধু শিরোপা নয়, নিজের আত্মবিশ্বাসও ফিরে পেলেন তিনি।
ক্লাব ক্যারিয়ারের উত্থান
শ্রাবণের ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০২১ সালে বসুন্ধরা কিংসের মাধ্যমেই। এরপর ধারে খেলেছেন গোপালগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। সেখান থেকে আবারও ফিরে আসেন কিংসে। এখন পর্যন্ত কিংসের হয়ে পাঁচটি শিরোপা জিতেছেন এই তরুণ প্রতিভা।
তার চোখেমুখে রয়েছে আরও শিখর ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাঁর খেলার ধরন, প্রতিক্রিয়া এবং ম্যাচের চাপে মাথা ঠান্ডা রাখার দক্ষতা ভবিষ্যতে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনাকে জোরালো করছে।
বসুন্ধরা কিংসের জয় এবং ভবিষ্যৎ
বসুন্ধরা কিংস দেশের ঘরোয়া ফুটবলে ইতোমধ্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। এই ফেডারেশন কাপ জয় শুধু আরেকটি ট্রফি নয়, বরং ক্লাবের শক্তিশালী রোস্টার এবং গভীর স্কোয়াডের প্রমাণ।
শ্রাবণের মতো তরুণদের উঠে আসা মানে শুধু কিংস নয়, জাতীয় দলের ভবিষ্যতের জন্যও সুখবর। বিশেষত গোলরক্ষক পজিশনে যোগ্য ও সাহসী খেলোয়াড় পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মিডিয়ায় ভাইরাল, সামাজিক মাধ্যমেও প্রশংসা
ম্যাচের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় শ্রাবণের সেই মার্তিনেজ-স্টাইল উদযাপন। ফুটবলপ্রেমীরা বলছেন, “বাংলাদেশের মার্তিনেজ এখন শ্রাবণ”। ইউটিউব ও ফেসবুকে তাঁর সেই পেনাল্টি সেভ ও উদযাপন মুহূর্ত ইতিমধ্যেই হাজার হাজার ভিউ পেয়ে গেছে।
ময়মনসিংহ জেলা স্টেডিয়ামে ফেডারেশন কাপের ফাইনাল শুধুমাত্র একটি ম্যাচ ছিল না—এটি ছিল একটি গল্পের জন্ম। মেহেদী হাসান শ্রাবণ শুধু একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে শিরোপা এনে দেননি, বরং প্রমাণ করেছেন যে দেশের তরুণদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের তারকা।
আর্জেন্টিনার মার্তিনেজ যদি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন, তবে বাংলাদেশের মাঠেও আজ একজন শ্রাবণ উঠে এসেছেন, যিনি অনুপ্রেরণা নিতে জানেন, এবং সেই অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের গল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে প্রস্তুত।