হামজার সুবাদে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে বাংলাদেশের নাম

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ — ফুটবল দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি লিগ। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিভাবান ফুটবলাররা এই লিগে খেলার স্বপ্ন দেখেন। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা আফ্রিকা—প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকেই কেউ না কেউ প্রতিনিধিত্ব করেছেন এই মঞ্চে। তবে বাংলাদেশ, একসময় যাকে ফুটবলশূন্য দেশ বলেই ধরে নেওয়া হতো, সেই দেশের নামও এখন জায়গা করে নিয়েছে এই মর্যাদার লিগের ইতিহাসে। আর এই কৃতিত্বের পিছনে যার নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল, তিনি হলেন হামজা চৌধুরী।
হামজা চৌধুরী: ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি
২৭ বছর বয়সী মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডেই। তাঁর বাবা বাংলাদেশি ও মা গ্রানাডিয়ান। ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও শিকড় গাঁথা রয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হামজা লেস্টার সিটির একাডেমিতে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে জায়গা করে নেন মূল দলে।
২০১৭-১৮ মৌসুমে লেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগে তাঁর অভিষেক ঘটে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি লেস্টারের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ৫৭টি ম্যাচ খেলেছেন।
বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক
ক্লাব ফুটবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন হামজা। যদিও তাঁর পক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি বেছে নেন পিতৃভূমি বাংলাদেশকে।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে বাংলাদেশের জার্সিতে তাঁর অভিষেক হয়। এই ম্যাচের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন প্রথম বাংলাদেশি, যিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচে দেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন এবং একইসঙ্গে প্রিমিয়ার লিগেও খেলেছেন।
প্রিমিয়ার লিগের ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের পতাকা
সম্প্রতি প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ ফেসবুক পোস্ট করে। পোস্টটির উদ্দেশ্য ছিল—বিশ্বজুড়ে যে ১২৬টি দেশের ফুটবলাররা এই লিগে অংশ নিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং বৈচিত্র্যকে উদ্যাপন করা। প্রত্যেক দেশের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা একজন করে খেলোয়াড়ের নাম ও তাদের জাতীয় পতাকা উল্লেখ করা হয় পোস্টটিতে।
বাংলাদেশের হয়ে যেহেতু কেবল হামজা চৌধুরীই প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার নামই যুক্ত হয় সেই তালিকায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। ফলে ইতিহাসের পাতায় প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগের এক অফিসিয়াল পোস্টে ঠাঁই পায় বাংলাদেশ।
এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য একটি গৌরবের মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে যেখানে এখনও নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেনি বাংলাদেশের জাতীয় দল, সেখানে প্রিমিয়ার লিগের মতো একটি অভিজাত লিগের ইতিহাসে দেশের নাম উঠে আসা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক।
ক্লাব ক্যারিয়ারে পরিবর্তন
বর্তমানে হামজা ধারে খেলছেন ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের ক্লাব শেফিল্ড ওয়েন্সডে-এর হয়ে। যদিও তাঁর মূল ক্লাব লেস্টার সিটি, তবে তাদের পারফরম্যান্স বর্তমানে হতাশাজনক। প্রিমিয়ার লিগের চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৩১ ম্যাচে মাত্র ১৭ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবিলের ১৯তম স্থানে রয়েছে তারা। এর মানে, অবনমনের আশঙ্কা প্রবল।
এই পরিস্থিতিতে হামজার প্রিমিয়ার লিগে আবার খেলার সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী মৌসুমে কোন ক্লাবে তিনি খেলবেন তার ওপর। যদি লেস্টার অবনমিত হয় এবং তিনি অন্য কোনো প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবে চলে যান, তবে হয়তো আবারও তাঁকে দেখা যাবে সেই উচ্চস্তরের লিগে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আর কে?
হামজা চৌধুরীর আগে দক্ষিণ এশিয়া থেকে খুব কম ফুটবলারই প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক ডিফেন্ডার জেশ রহমান সেই গুটিকয়েক নামের মধ্যে একজন। তিনি ইংল্যান্ডের ফুলহ্যাম ক্লাবের হয়ে তিন মৌসুমে ২১টি ম্যাচ খেলেছেন। তবে তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাই দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান প্রজন্মে প্রিমিয়ার লিগে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র ফুটবলার হামজা চৌধুরী।
প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে রেকর্ডধারীরা
প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে ইংল্যান্ডের মিডফিল্ডার গ্যারেথ ব্যারি-র। তিনি চারটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে মোট ৬৫৩টি ম্যাচ খেলেছেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ওয়েলশ ফুটবলার রায়ান গিগস, যার ম্যাচ সংখ্যা ৬৩২।
এইসব কিংবদন্তিদের কাতারে হয়তো হামজা চৌধুরীর নাম আসবে না, তবে বাংলাদেশি হিসেবে তার অবদান নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
হামজা চৌধুরীর প্রিমিয়ার লিগে অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক—এ দুটি ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তি ক্রীড়াবিদের সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য একটি প্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত। তরুণ প্রজন্মের জন্য এটা একটি বার্তা: সঠিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং সুযোগ পেলে বাংলাদেশের ছেলেরা আন্তর্জাতিক ফুটবলেও আলো ছড়াতে পারে।
ফেসবুকের একটি পোস্টে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ঠাঁই পাওয়ার মধ্যে দিয়ে যে আত্মমর্যাদার প্রতিফলন ঘটেছে, তা দেশের ফুটবলের ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।