ফুটবল

বিশ্বকাপ জেতা খুব কঠিন, ভাগ্য আমাদের পাশে ছিল: মেসি

Advertisement

ফুটবল ইতিহাসের সেরা মুহূর্তগুলোর কথা উঠলে কাতার বিশ্বকাপ সব সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। সময়ের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির নেতৃত্বে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নাটকীয় শিরোপা জয় শুধু ফুটবলপ্রেমীদের নয়—ক্রীড়া ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে রেখেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আর্জেন্টিনা উদযাপন করবে তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের তিন বছর পূর্তি। এর আগেই সেই স্মৃতি ঘেঁটে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন মেসি।

ইএসপিএনকে দেওয়া একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে মেসি জানান, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলেও পুরোটা পথ ছিল কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর ভাষায়—
“বিশ্বকাপ জেতা খুবই কঠিন। আপনি যত প্রস্তুতি নিন না কেন, ফুটবল ভাগ্যের খেলা—এক ইঞ্চি এদিক-সেদিকেই সব বদলে যায়।”

হারের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনার শিরোপা যাত্রার শুরু

কাতার বিশ্বকাপের সূচনাটা আর্জেন্টিনার জন্য ছিল ভয়াবহ। প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে ২–১ গোলে হেরে যায় মেসির দল। এমন হার শুধু আর্জেন্টিনা নয়, পুরো ফুটবল বিশ্বের জন্যই ছিল অপ্রত্যাশিত। ম্যাচটি ছিল অনেকটা ঝড়ের মতো, যা আর্জেন্টিনাকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল।

মেসি জানান—
“সৌদি আরবের ম্যাচটি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। সেই হারই দলকে আরও ঐক্যবদ্ধ করেছিল।”

বিশ্বকাপজয়ী অন্যান্য দলের মতো আর্জেন্টিনাও সেই বিপর্যয়কে শক্তিতে পরিণত করে। পরের ম্যাচগুলোতে দুর্দান্ত প্রতাপ দেখিয়ে তারা গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে গেল আত্মবিশ্বাস নিয়ে।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১২০ মিনিটের নাটক—মেসির চোখে এখনও অবিশ্বাস্য

২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল পুরো টুর্নামেন্টের অন্যতম নাটকীয় ম্যাচ। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–০ গোলে এগিয়ে থাকার পর ম্যাচ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে দুই গোল হজম করে। খেলাটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, সেখান থেকে টাইব্রেকারে।

মেসি বলেন—
“নেদারল্যান্ডস ম্যাচটি আমি কখনও ভুলব না। আমরা দারুণ খেলছিলাম। তারপর সবকিছু বদলে গেল কয়েক মিনিটে। তখন মনে হয়েছিল—এটাই হয়তো শেষ।”

কিন্তু ভাগ্য আর্জেন্টিনার ওপর তখনও হাসছিল। গোলবারে ছিলেন এমিলিয়ানো ‘দিবু’ মার্তিনেস—যিনি পেনাল্টি শুটআউটে দেখিয়েছিলেন অসাধারণ দৃঢ়তা।

মেসির ভাষায়—
“দিবু মার্তিনেস আমাদের বারবার বাঁচিয়েছে। সে না থাকলে কী হতো, কেউ বলতে পারে না।”

ফাইনাল: ফুটবল ইতিহাসের সেরা ম্যাচ—মেসি বললেন ‘এটা ছিল ভাগ্য আর লড়াইয়ের মিশেল’

আর্জেন্টিনা–ফ্রান্স ফাইনালকে অনেক বিশ্লেষক ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফাইনাল বলে মনে করেন।
প্রথমার্ধে ২–০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র ৯৭ সেকেন্ডে দুবার গোল করে সমতা ফেরান কাইলিয়ান এমবাপে

মেসি সেই মুহূর্তগুলো স্মরণ করে বলেন—
“আমরা প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে ম্যাচ জিতে গেছি। কিন্তু এমবাপে পুরো ম্যাচের গল্প বদলে দিল। ফুটবল এমনই অনিশ্চিত।”

অতিরিক্ত সময়ে আবার লিড নেয় আর্জেন্টিনা। কিন্তু আবারও এমবাপের গোল—হ্যাটট্রিক। ম্যাচ আবার গড়ায় পেনাল্টিতে।

সেখানেও ভাগ্য হাত বাড়িয়ে দেয় আর্জেন্টিনার দিকে। দিবু মার্তিনেস একের পর এক সেভ করে আর্জেন্টিনাকে এনে দেন বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপা।

মেসির ভাষায়—
“ফাইনাল ম্যাচটা যেন সিনেমা। পেনাল্টিতে যখন গেলাম, মনে হয়েছিল এখন সবই ভাগ্য।”

বিশ্বকাপ: দক্ষতা, লড়াই আর ভাগ্যের সম্মিলন

মেসি তার সাক্ষাৎকারে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বিশ্বকাপ জিততে শুধু দক্ষতা বা পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। ভাগ্যও বড় ভূমিকা পালন করে।

তিনি বলেন—
“বল পোস্টে লেগে বাইরে চলে যেতে পারে, আবার ভেতরে ঢুকতেও পারে। একটুখানি ভুলেই পুরো যাত্রা শেষ। তাই বিশ্বকাপ জেতা খুবই কঠিন।”

মেসির মতে, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স—দুই ম্যাচেই আর্জেন্টিনা ভালো খেললেও ম্যাচ শেষ হয়েছে টাইব্রেকারে। সেখানে ‘দিবু মার্তিনেস’ আবারও নায়ক।

মেসির কথায়—
“দিবু থাকায় আমরা পেনাল্টিতে আত্মবিশ্বাস পেতাম। কিন্তু পেনাল্টি ভাগ্যের জায়গা—সেদিন ভাগ্য আমাদের পাশে ছিল।”

আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ: ইতিহাস, আবেগ এবং এক নতুন যুগের সূচনা

কাতার বিশ্বকাপ শুধু একটি ট্রফি জয়ের গল্প নয়—এটি ছিল এক যুগের পরিসমাপ্তি ও নতুন এক কিংবদন্তি গল্পের শুরু।

মেসির পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে একটি প্রশ্ন ছিল—
“তিনি কি বিশ্বকাপ জিততে পারবেন?”

২০২২ সালে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনাও পেল ১৯৮৬ সালের পর প্রথম শিরোপা।

বিশ্লেষকরা বলেন—
এই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার শুধু ফুটবলীয় জয় নয়, এটি ছিল নেতৃত্ব, দলগত মনোভাব, ত্যাগ, দৃঢ়তা এবং আবেগের মহাসমারোহ।

মেসি: তিন বছর পরও উত্তেজনায় ভরা স্মৃতি

২০২৫ সালের সাক্ষাৎকারে মেসিকে যখন ওই সময়ের কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি আবেগঘন কণ্ঠে জানান—

“মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। বিশ্বকাপ আমাদের জীবনই বদলে দিয়েছে। পুরো যাত্রাটি ছিল আবেগ আর নাটকীয়তায় পূর্ণ। ভাগ্য সবসময় যোদ্ধাদের সঙ্গ দেয়—আমরা লড়াই করেছি, ভাগ্যও আমাদের পাশে ছিল।”

কেন মেসি বলছেন—”বিশ্বকাপ জেতা ভাগ্যের ব্যাপার”?

● বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচই নকআউটের মতো
● ছোটখাটো ভুলেই ভেঙে পড়ে স্বপ্ন
● পোস্টে লেগে ফিরে যাওয়া বল একটি দলের ভাগ্য বদলে দিতে পারে
● পেনাল্টি শুটআউট প্রায় পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক ও ভাগ্যনির্ভর
● চাপ সামলায় যেসব খেলোয়াড়—তারাই ইতিহাস লেখে

দিবু মার্তিনেসের মতো গোলরক্ষক থাকায় আর্জেন্টিনা সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘ভাগ্য’ শব্দটি মেসি বারবার উচ্চারণ করেছেন কারণ—
ফুটবলে ছোট ঘটনাই বড় ইতিহাস তৈরি করে।

২০২২ বিশ্বকাপ: আরও কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য (সংযোজন)

১. মেসির রেকর্ড

● একমাত্র ফুটবলার যিনি পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করেছেন
● বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড (২৬)
● বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় (গোল্ডেন বল) দুইবার জয়—একমাত্র খেলোয়াড়

২. আর্জেন্টিনার দলীয় পরিসংখ্যান

● টুর্নামেন্টে মোট গোল: ১৫
● পেনাল্টি থেকে সবচেয়ে বেশি গোল
● সবচেয়ে নাটকীয় ফাইনালের ইতিহাস রচনা

৩. দিবু মার্তিনেস

● টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক (গোল্ডেন গ্লাভস)
● নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স—দুটি নকআউটে নায়ক

ফুটবল বিশ্বে প্রতিক্রিয়া

অনেক পণ্ডিত, বিশ্লেষক ও সাবেক তারকা মেসির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন—
বিশ্বকাপ জিততে প্রতিভা লাগে, সাহস লাগে, কিন্তু ভাগ্য লাগাটা সবচেয়ে বড়।

ব্রাজিলের কিংবদন্তি রিভালদো বলেন—
“বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে আপনাকে ফুটবল দেবতা একটু হলেও সাহায্য করতে হয়।”

পর্তুগালের লুইস ফিগো বলেন—
“আর্জেন্টিনা ২০২২ টিমটি ছিল ভারসাম্যপূর্ণ, কিন্তু ভাগ্য ছিল তাদের সঙ্গে।”

মেসির কথায় স্পষ্ট—আর্জেন্টিনা ২০২২ বিশ্বকাপ জিতেছিল কঠোর পরিশ্রম, দলগত ঐক্য এবং অসাধারণ প্রতিভার মাধ্যমে। কিন্তু সেই জয়ের পেছনে ভাগ্যের ছোঁয়াও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে প্রতিটি মুহূর্তেই থাকে অনিশ্চয়তা।

আজ তিন বছর পরও ২০২২ বিশ্বকাপের আবেগ, উত্তেজনা, আনন্দ এবং নাটকীয়তা ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে একইভাবে জেগে আছে। আর সেই স্মৃতি মনে করেই মেসি আবার মনে করিয়ে দিলেন—
“বিশ্বকাপ জেতা কখনোই সহজ নয়, তবে ভাগ্য আমাদের পাশে ছিল বলে আমরা ইতিহাস লিখতে পেরেছি।”

MAH – 14131 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button