ফুটবল

ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে পর্তুগাল

Advertisement

ফিফা অনূর্ধ্ব–১৭ বিশ্বকাপ মানেই ফুটবলের আরেকটি রোমাঞ্চকর গল্প, তরুণদের দাপট, ভবিষ্যৎ তারকাদের জন্ম। আর সেই গল্পের এক দারুণ অধ্যায় যোগ হলো কাতারের অ্যাসপিরে স্টেডিয়ামে, যেখানে ইউরোপের ফুটবল শক্তি পর্তুগাল নাটকীয় এক ম্যাচে দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী দল ব্রাজিলকে হারিয়ে নিশ্চিত করেছে ফাইনালের টিকিট। ম্যাচটি নিছক একটি খেলা নয়, যেন ছিল ফুটবলের ক্লাসিক যুদ্ধ, প্রতিটি মিনিটে চাপ, উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তার রোমাঞ্চে ভরপুর।

৯০ মিনিটের লড়াইয়ে কোনো গোল হয়নি। অতিরিক্ত ছয় মিনিটেও মিলল না গোলের দেখা। শেষমেশ দুই দলকে নিতে হলো ভাগ্যের লড়াই পেনাল্টি শুটআউটে। সেখানেই নির্ধারিত হয় বিজয়ী—আর সেই জয় ওঠে পর্তুগালের ঝুলিতে।

এই ম্যাচ পর্তুগালের ইতিহাসে জায়গা করে নেবে নিশ্চিতভাবেই। কারণ ব্রাজিল হলো বয়সভিত্তিক ফুটবলের সবচেয়ে সফল দলগুলোর একটি। অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপেই তারা পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন। এমন একটি দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা কোনো সহজ কাজ নয়। কিন্তু পর্তুগালের তরুণ যোদ্ধারা দেখিয়ে দিল—সংঘবদ্ধতায়, শান্ততায় এবং সঠিক সময়ে দৃঢ়তায় জিততেই পারে সেরা দল।

দুই দলই আক্রমণে তীব্র, কিন্তু গোলশূন্য সমাপ্তি

ম্যাচ শুরুর প্রথম মুহূর্ত থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, এটি হবে টানটান লড়াই। ব্রাজিল চেষ্টা করছিল দ্রুতগতির আক্রমণে খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে পর্তুগাল মনোযোগ দিয়েছে ছোট ছোট পাসে, রক্ষণভাগ শক্ত রেখে ধীরে ধীরে আক্রমণে ওঠায়।

বল দখলে এগিয়ে ছিল পর্তুগাল। ব্রাজিল পজিশন ধরে রাখতে পেরেছে মোটে ৪৪ শতাংশ সময়। যদিও আক্রমণে দারুণ তৎপরতা দেখিয়েছে ব্রাজিল। তারা নিয়েছে মোট আটটি শট, যার দুটি ছিল সরাসরি গোলমুখে। পর্তুগালও পাল্টা লড়াইয়ে থেমে থাকেনি। তারা নিয়েছে চারটি শট। যদিও খুব পরিষ্কার সুযোগ তৈরি হয়নি।

প্রথমার্ধ শেষে পর্তুগাল কিছুটা বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল। তাদের রক্ষণ সামলেছে ব্রাজিলের দ্রুত আক্রমণগুলো ভালোভাবেই। দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল আক্রমণের মাত্রা আরও বাড়ায়। বিশেষ করে উইং থেকে কয়েকটি আক্রমণ পর্তুগালকে বিপদে ফেলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বা গোলরক্ষক কুনহার দৃঢ়তায় বেঁচে যায় দলটি।

ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে দুই দলই চেষ্টা করেছে শেষ মুহূর্তে গোল পাওয়ার। তবে ভাগ্য কারো পক্ষে ছিল না। অবশেষে ম্যাচ গড়ায় সেই রুদ্ধশ্বাস পেনাল্টি শুটআউটে।

পেনাল্টি শুটআউট: নাটকীয়তার চূড়ান্ত

পেনাল্টি শুটআউট মানেই স্নায়ুর লড়াই। খেলার পরিশ্রম, কৌশল সবই তখন ম্লান—কেবল থাকে স্নায়ুর স্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাস।

প্রথম পাঁচ পেনাল্টি: সমতায় দুই দল

শুটআউটের প্রথম শট নেন পর্তুগালের টমাস আলভেস। বাঁ প্রান্ত লক্ষ্য করে নিখুঁত শটে গোল করেন তিনি। জবাবে ব্রাজিলের ডেলও গোল করেন একই কৌশলে। কুনহা ডাইভ দিলেও বল পৌঁছায়নি তার হাতে।

দ্বিতীয় শটে পর্তুগালের কা জোরালো শটে গোল করেন। ব্রাজিলের থিয়াগোও পাল্টা গোল করেন ঠাণ্ডা মাথায় ডানদিকে নিচু শটে।

তৃতীয় শটে সান্তিয়াগো সিলভা সহজেই গোল করে যান। ব্রাজিলও পিছিয়ে না থেকে তাদের মিডফিল্ডার লুকাসকে দিয়ে গোল করায়।

চতুর্থ শটে জোয়াও পেদ্রো গোল করেন পর্তুগালের হয়ে। ব্রাজিলের হয়ে ফেলিপেও সামাল দেন চাপ, গোল আনেন দলের পক্ষে।

পাঁচটি শট শেষে দুই দলই পাঁচ গোল করে। তাই ম্যাচ গড়ায় সিদ্ধান্তের সবচেয়ে কঠিন ধাপ—সাডেন ডেথ।

সাডেন ডেথ: এক ভুলের মূল্য পুরো বিশ্বকাপ

সাডেন ডেথের প্রথম শটে পর্তুগালের গোলরক্ষক কুনহা নিজেই শট নিতে আসেন। কিন্তু তিনি বার অনেক ওপরে শট নিয়ে ভুল করে বসেন। এতে ব্রাজিলের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ব্রাজিলের পাবলোও সেই সুবিধা কাজে লাগাতে পারেননি। তার নেওয়া শট বারে লেগে ফিরে আসে। দুই দলই ওয়াকিবহাল, এখন আর ভুল করার অবকাশ নেই।

দ্বিতীয় শট নেন পর্তুগালের জোয়াও আরাগোয়া। তিনি সফল হন। ব্রাজিলের গ্যাব্রিয়েল মেকও গোল করেন। আবার সমতা।

পর্তুগালের তৃতীয় শট নিতে আসেন নেটো। তিনি গোল করে চাপ ব্রাজিলের দিকে টেনে দেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটে ম্যাচের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ব্রাজিলের সিকুই শট নেন উঁচু করে—বল বারের ওপর দিয়ে আকাশে উঠে হারিয়ে যায়। আর সেই মুহূর্তেই বিদায় ঘটে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের।

পর্তুগালের খেলোয়াড়রা দৌড়ে গিয়ে নেটোকে জড়িয়ে ধরে উদযাপন শুরু করেন। গোলরক্ষক কুনহাও ছুটে আসেন সতীর্থদের দিকে। অন্যদিকে ব্রাজিলের সিকুই দাঁড়িয়ে ছিলেন একা, মাথা নিচু করে। সতীর্থরা এসে তাকে সান্ত্বনা দেন। তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হলো এক মুহূর্তের ভুলে।

পর্তুগালের সাফল্য: একটি স্বপ্নপথের দারুণ ধাপ

পর্তুগালের ফুটবল ঐতিহ্য যেকোনো বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা টেকনিক্যাল ফুটবলের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। অনূর্ধ্ব ১৭–এও তারা সবসময়ই নজরকাড়া দল গড়ে থাকে। এই বিশ্বকাপে পর্তুগাল ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলেছে। গ্রুপ পর্ব থেকে নক–আউটে উঠে তারা প্রতিটি ম্যাচে দেখিয়েছে ম্যাচ রিডিং, রক্ষণভাগের দৃঢ়তা এবং গোলরক্ষকের অসাধারণ পারফরম্যান্স।

সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে হারানো নিছক একটি জয় নয়; এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক শক্তি। ফুটবলের ভবিষ্যত তারকারা যখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল শক্তিকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে, তখন তা দেশের ফুটবল উন্নয়নে নতুন বিশ্বাস এনে দেয়।

ব্রাজিল: হারলেও সম্মান অক্ষুণ্ণ

ব্রাজিল যুব ফুটবলে সর্বদাই আধিপত্যের প্রতীক। তারা প্রতিভার ভাণ্ডার। এই দলটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ফুটবল সবসময় ন্যায্য ফল দেয় না। তারা সুযোগ তৈরি করেছে, আক্রমণ করেছে, কিন্তু গোলের দেখা পায়নি। শেষমেশ ভাগ্যের খেলায় পেনাল্টি শুটআউটে মুখ থুবড়ে পড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।

তবে ব্রাজিলের পারফরম্যান্স ভবিষ্যতে এই খেলোয়াড়দের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের ইঙ্গিতই দেয়। বিশ্বের সব বড় ক্লাবই বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপগুলোতে নজর দেয়। ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের প্রতিভা সেই আগ্রহ আরও বাড়াবে।

ফাইনাল: পর্তুগালের স্বপ্ন এখন হাতের নাগালে

এই জয়ের মাধ্যমে পর্তুগাল উঠে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ হবে ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার আরেক শক্তিশালী দল। প্রতিপক্ষ যেই হোক, পর্তুগালের সামনে অপেক্ষা করছে আরেকটি ইতিহাস রচনার সুযোগ।

পর্তুগালের কোচ ম্যাচ শেষে বলেছেন, এই জয় শুধু একটি ম্যাচের জয় নয়, এটি তরুণদের পরিশ্রমের জয়, আত্মবিশ্বাসের জয় এবং পর্তুগিজ ফুটবলের ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

ফুটবল সৌন্দর্যের খেলা। কখনো আক্রমণ, কখনো কৌশল, কখনো স্নায়ুর লড়াই—সব মিলেই ফুটবলকে নিয়ে যায় অন্য উচ্চতায়। সেই উচ্চতার এক অসাধারণ অনুভূতি দিল ফিফা অনূর্ধ্ব–১৭ বিশ্বকাপের এই সেমিফাইনাল।

এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত বদলে দিল পুরো গল্প। ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ্গ হলেও পর্তুগাল পেল নতুন স্বপ্নের আলো। এখন দৃষ্টি ফাইনালের দিকে—যেখানে অপেক্ষা করছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ এবং আরও বড় সাফল্যের সম্ভাবনা।

MAH – 13971 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button