কিলিয়ান এমবাপ্পের স্বপ্নপূরণ, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে প্রথম ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট
ফুটবল দুনিয়া জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন এক নাম—কিলিয়ান এমবাপ্পে। রিয়াল মাদ্রিদের এই ফরাসি ফরোয়ার্ড ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জিতে লিখেছেন নতুন ইতিহাস। লা লিগার ২০২৪-২৫ মৌসুমে এমবাপ্পের পায়ের জাদুতে কাঁপিয়েছে প্রতিপক্ষ রক্ষণের দেয়াল। মৌসুম শেষে লিগে করেছেন ৩১ গোল, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গোলসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪—যা তাকে এনে দিয়েছে ইউরোপের সেরা গোলদাতার সম্মাননা।
গত শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর উজ্জ্বল আলোয় সাজানো মঞ্চে এমবাপ্পের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট ট্রফি। রিয়াল মাদ্রিদের কোচ, সতীর্থ ও শত শত দর্শকের সামনে এই সম্মাননা গ্রহণ করে উচ্ছ্বসিত কিলিয়ান বলেন—
“এটি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের একটি মুহূর্ত। গোল্ডেন বুট জেতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটি আমাদের পুরো দলের কঠোর পরিশ্রমের ফল। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এই পুরস্কার পাওয়াটা আমার স্বপ্নের মতো।”
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে নতুন যুগের সূচনা
এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে যোগ দিয়েছিলেন ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে, দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও একাধিক গুজবের অবসান ঘটিয়ে। ক্লাব ইতিহাসে অন্যতম বড় ট্রান্সফার হিসেবে আসেন তিনি, আর যোগদানের প্রথম মৌসুমেই প্রমাণ করেছেন কেন তাঁকে বলা হয় আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা।
রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে তার প্রথম মৌসুমটি ছিল একেবারে রূপকথার মতো। লা লিগায় ৩১ গোলের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে করেছিলেন ৯টি গোল এবং কোপা দেল রেতে আরও ৪টি। তার গোলেই রিয়াল পৌঁছায় ট্রেবল জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
ক্লাবের সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এমবাপ্পের প্রশংসা করে বলেন—
“রিয়াল মাদ্রিদ এমন এক খেলোয়াড় পেয়েছে, যিনি একাই ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। এমবাপ্পে আমাদের ভবিষ্যতের প্রতীক।”
ক্যারিয়ারের প্রথম ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট
এই গোল্ডেন বুট এমবাপ্পের ক্যারিয়ারের প্রথম, কিন্তু এটি অনেকের মতে তার “অনেকগুলোর প্রথমটি” মাত্র।
ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগ—লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেসলিগা, সেরি-আ ও লীগ ওয়ানে—মৌসুমজুড়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা যে খেলোয়াড় হন, তাকেই এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার দেওয়া হয়।
পূর্বে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো চারবার, আর লিওনেল মেসি রেকর্ড ছয়বার এই পুরস্কার জিতেছেন। এমবাপ্পে এখন সেই কিংবদন্তিদের কাতারে নাম লেখালেন।
রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে এমবাপ্পে হলেন তৃতীয় খেলোয়াড় যিনি গোল্ডেন বুট জয় করলেন। এর আগে ২০১০-১১ ও ২০১৪-১৫ মৌসুমে রোনালদো জিতেছিলেন এই পুরস্কার।
এমবাপ্পের প্রতিক্রিয়া: “রিয়ালের হয়ে খেলা আমার স্বপ্ন ছিল”
পুরস্কার হাতে নিয়ে এমবাপ্পে বলেন,
“ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলার। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে। আমি চাই রিয়ালের হয়ে বহু বছর খেলতে, অনেক শিরোপা জিততে এবং ক্লাবের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে যেতে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমি আমার সতীর্থ, কোচ, পরিবার ও সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের ছাড়া এই অর্জন অসম্ভব ছিল। রিয়াল মাদ্রিদের ভক্তদের ভালোবাসাই আমাকে প্রতিদিন আরও ভালো খেলোয়াড় হতে অনুপ্রাণিত করে।”
ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমবাপ্পের আধিপত্য
মৌসুমজুড়ে এমবাপ্পে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। শুধু গোল নয়, তার গতি, ড্রিবলিং, আর নিখুঁত ফিনিশিং প্রতিপক্ষ রক্ষণের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করে দলকে এনে দিয়েছেন জয়সূচক মুহূর্ত।
লা লিগার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে তার গোলগুলোই রিয়ালকে ফাইনালে পৌঁছে দেয়।
ফাইনালে যদিও দল জুভেন্টাসের কাছে হেরে যায়, তবে এমবাপ্পের পারফরম্যান্স ছিল অনন্য।
ফুটবল বিশ্লেষক গিলেম বালাগ বলেন—
“এমবাপ্পে এমন এক খেলোয়াড়, যিনি শুধু প্রতিপক্ষকে হারান না, খেলার গতি ও ধরনই বদলে দেন। মেসি-রোনালদোর পরবর্তী প্রজন্মে তিনি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় নাম।”
চলতি মৌসুমেও দুর্দান্ত ফর্মে
২০২৫-২৬ মৌসুমের শুরুতেও এমবাপ্পে আগুনে ফর্মে আছেন। ইতোমধ্যে লা লিগায় করেছেন ১১ গোল ১০ ম্যাচে, আর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গোল ১৬।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি তিনি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন, তবে পরবর্তী মৌসুমেও ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জয়ের সবচেয়ে বড় দাবিদার হবেন তিনিই।
ব্যক্তিগত জীবনে সংযমী, মাঠে আগুনে যোদ্ধা
ফরাসি এই তারকা তার পেশাদার মনোভাব ও জীবনযাপনের জন্যও পরিচিত। অনেক সুপারস্টারের মতো অতিরিক্ত বিলাসিতার পথে হাঁটেন না এমবাপ্পে। বরং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই তার লক্ষ্য।
তিনি নিয়মিতভাবে দাতব্য সংস্থায় অনুদান দেন, শিশুদের জন্য ফুটবল একাডেমি গড়ে তোলার কাজেও যুক্ত আছেন।
২০১৮ সালে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতাতে মুখ্য ভূমিকা রাখার পর থেকেই তিনি বিশ্বের তরুণদের কাছে এক প্রেরণার নাম।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: ব্যালন ডি’অর জেতা
এমবাপ্পে বরাবরই বলেছেন—তার ক্যারিয়ারের পরবর্তী বড় লক্ষ্য হলো ব্যালন ডি’অর জেতা।
তিনি বলেন,
“গোল্ডেন বুট আমার জন্য গর্বের, কিন্তু আমি জানি আরও অনেক কিছু জেতা বাকি আছে। আমি প্রতিদিন আরও উন্নতি করতে চাই, কারণ আমি জানি আমি আরও অনেক কিছু দিতে পারি।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি এমবাপ্পে বর্তমান ফর্ম বজায় রাখেন, তবে ২০২৫ সালের ব্যালন ডি’অর তার হাতেই উঠবে।
রিয়াল মাদ্রিদের নতুন রাজত্বের প্রতীক
এমবাপ্পে শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড় নন, তিনি এখন রিয়াল মাদ্রিদের নতুন যুগের প্রতীক।
যেখানে একসময় রোনালদো রাজত্ব করেছেন, সেখানে এখন তার উত্তরসূরি হিসেবে নিজের স্থান পাকা করছেন এমবাপ্পে।
রিয়ালের তরুণ তারকা ভিনিসিয়াস জুনিয়র বলেন—
“এমবাপ্পের সঙ্গে খেলা মানেই অনুপ্রেরণা। তিনি আমাদের দলের হৃদয়।”
ফুটবলপ্রেমীদের প্রতিক্রিয়া
বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীরা সামাজিক মাধ্যমে এমবাপ্পেকে শুভেচ্ছায় ভাসিয়েছেন।
টুইটারে ‘#GoldenBootWinnerMbappe’ ট্রেন্ড করেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রিয়ালের সমর্থকরা লিখেছেন—
“স্বপ্ন সত্যি হলো! এমবাপ্পে আমাদের গর্ব।”
কিলিয়ান এমবাপ্পে আজ শুধুই একজন ফুটবলার নন, তিনি আধুনিক ফুটবলের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার পায়ের ছোঁয়ায় যেমন তৈরি হয় জাদু, তেমনি তার ব্যক্তিত্বে ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাস, সংযম ও স্বপ্নের প্রতিফলন।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম মৌসুমেই গোল্ডেন বুট জয় করে তিনি শুধু নিজের নয়, পুরো ক্লাবের গৌরব বাড়িয়েছেন।
এখন চোখ ফুটবলবিশ্বের পরবর্তী বড় পুরস্কারে—ব্যালন ডি’অর। ফুটবল বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ভাগ্য সঙ্গ দেয়, ২০২৫ সালের সেই সোনালী বলও এমবাপ্পের হাতে উঠতে বাধা নেই।
MAH – 13567 I Signalbd.com



