তালেবান শাসনের অন্ধকার পেরিয়ে ফুটবলের সবুজ মাঠে
তালেবানদের কঠোর শাসনের পর আফগানিস্তানের নারীদের জীবন থমকে গিয়েছিল। শিক্ষা, কাজ, খেলাধুলা—সব ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেয় নতুন শাসকগোষ্ঠী। বিশেষ করে খেলাধুলায় নারীদের উপস্থিতি প্রায় শূন্যে নেমে আসে। কিন্তু চার বছর পর সেই নিষেধাজ্ঞার দেয়াল ভেঙে এক নতুন আলো নিয়ে ফিরেছেন আফগান নারী ফুটবলাররা।
২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করার পর জাতীয় নারী ফুটবল দলটি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেউ আশ্রয় নেন অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ কানাডায়, কেউ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে প্রিয় দেশের ফুটবল মাঠেই। আজ, চার বছর পর সেই স্বপ্ন আবার ডানা মেলেছে মরক্কোর মাটিতে।
‘আফগান উইমেন ইউনাইটেড’—নতুন নামে পুরনো স্বপ্নের দল
ফিফার আয়োজনে মরক্কোতে শুরু হয়েছে চার জাতির এক বিশেষ প্রীতি টুর্নামেন্ট। সেখানে আফগানিস্তানের পতাকা না থাকলেও, আছে আফগান নারীদের আত্মা ও সংগ্রামের প্রতীক। তারা অংশ নিয়েছেন ‘Afghan Women United’ নামে একটি স্বাধীন শরণার্থী দলের হয়ে।
এই টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে আরও তিনটি দেশ—চাদ, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া। রোববার মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কার মাঠে টুর্নামেন্টের উদ্বোধন হয়। আফগান নারীদের এই প্রত্যাবর্তনকে অনেকেই বলছেন “নারী স্বাধীনতার প্রতীকী জয়”।
অধিনায়ক ফাতিমা হায়দারির চোখে আশার আলো
ইতালিতে বসবাসরত আফগান নারী দলের অধিনায়ক ফাতিমা হায়দারি বলেন,
“একসঙ্গে দেখা হওয়া, জড়িয়ে ধরা, আবার এক মাঠে নামা—এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না। আমরা জানি, জীবন চ্যালেঞ্জে ভরা, কিন্তু প্রতিটি অন্ধকারের পরেই আলো আসে। হাল ছাড়া মানে হেরে যাওয়া, আর আমরা হার মানিনি।”
ফাতিমা আরও জানান, এই টুর্নামেন্ট শুধু খেলার নয়, বরং এক আত্মিক পুনর্জন্ম। তাদের প্রত্যেকেই একসময় আফগানিস্তানের জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন। আজ তারা নিজেদের পরিচয় ফিরে পাচ্ছেন নতুন নামে, নতুন পতাকার নিচে।
তালেবান নিষেধাজ্ঞা: নারী খেলোয়াড়দের বন্দি জীবন
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে নারীদের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
- মেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়।
- নারীদের ক্রীড়াচর্চা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
- মহিলা ক্রীড়াবিদদের হুমকি দেওয়া হয়, তাদের ছবি মুছে ফেলা হয় স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া দপ্তর থেকে।
একজন সাবেক খেলোয়াড় বলেন,
“আমরা একসময় জাতীয় দলের হয়ে গর্বের সঙ্গে মাঠে নামতাম। কিন্তু এক সকালে জেগে দেখি, আমরা ‘অস্তিত্বহীন’। খেলাধুলার সব সুযোগ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো।”
এই বাস্তবতা থেকেই অনেক নারী খেলোয়াড় গোপনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। কিছু খেলোয়াড়কে আশ্রয় দেয় অস্ট্রেলিয়া সরকার, যেখানে তারা ‘Afghan National Women’s Team in Exile’ নামে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
মরক্কো টুর্নামেন্টে ফিরে পাওয়া সাহস ও সংহতি
‘Afghan Women United’ দলটি মূলত গঠিত হয়েছে ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় আশ্রিত আফগান খেলোয়াড়দের নিয়ে। অনেকেই চার বছর ধরে বিদেশের মাটিতে নানা পেশায় যুক্ত ছিলেন, কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ পড়াশোনা করেন। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা তাদের আবার একত্র করেছে।
ফিফা এই উদ্যোগকে বলছে “Refugee Solidarity Cup”—একটি মঞ্চ যেখানে শরণার্থী খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রতিভা ও দৃঢ়তা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। এই প্রতিযোগিতা কেবল একটি ফুটবল ইভেন্ট নয়, এটি মানবাধিকার, সমতা ও নারীর মুক্তির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
আফগান নারী ফুটবলের ইতিহাস ও হারানো অধ্যায়
আফগান নারী ফুটবল দলটি গঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তারা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
- ২০১০ সালে তারা প্রথমবারের মতো SAFF Women’s Championship-এ খেলে।
- ২০১৬ সালে দলটি অংশ নেয় Asian Cup Qualifiers-এ।
- ২০১৮ সালে কাবুলে অনুষ্ঠিত হয় নারীদের ঘরোয়া ফুটবল লিগ।
কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরই সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফেডারেশনের ভবন দখল করে নেওয়া হয়, নারী খেলোয়াড়দের তালিকা পুড়িয়ে ফেলা হয়, এমনকি অনেক খেলোয়াড় পরিবারসহ পালাতে বাধ্য হন।
বিশ্বজুড়ে সমর্থন ও সংহতি
আফগান নারী ফুটবল দলের পাশে দাঁড়িয়েছে বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দেশ।
- অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন দলটির জন্য প্রশিক্ষণ মাঠ ও কোচিং সাপোর্ট দিয়েছে।
- ফিফা ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) এই পুনর্জন্মযাত্রায় আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে।
- ইংল্যান্ড ও নরওয়ের ক্লাব ফুটবলাররাও সামাজিক মাধ্যমে আফগান নারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
মরক্কোর স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এই দলের খেলার সময় দর্শকদের অভূতপূর্ব উৎসাহ দেখা যায়। গ্যালারিতে আফগান পতাকা, ব্যানার আর করতালির মাঝে শোনা গেছে একটাই স্লোগান—
“Freedom for Afghan Women!”
নারীদের জন্য বার্তা: ‘আমরা এখনো বেঁচে আছি’
দলের এক সদস্য মাহরুখ কাদিরি, যিনি আগে কাবুলের এক স্কুলে শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক ছিলেন, বলেন—
“আমরা মাঠে নামছি শুধু ফুটবলের জন্য নয়, বরং দেখাতে চাই আমরা এখনো বেঁচে আছি, আমরা আফগানিস্তানের নারী।”
তাদের এই অংশগ্রহণ অনেক তরুণী আফগান মেয়ের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য আফগান মেয়ে লিখেছে,
“তোমরা আমাদের আশা। একদিন আমরাও মাঠে ফিরব।”
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া: মানবাধিকার জয়ের বার্তা
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘটনাকে নারী অধিকার আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় হিসেবে দেখছে।
বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স—সব জায়গাতেই শিরোনাম একটাই:
“Afghan Women Return to the Field After Taliban Ban.”
ক্রীড়া বিশ্লেষকরা বলছেন,
“এটি কেবল একটি দল নয়, এটি আফগান নারীর পুনর্জাগরণ। তাদের মাঠে ফেরা মানে স্বাধীনতার দাবির এক নতুন অধ্যায়।”
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: ফিফার স্বীকৃতি পাওয়া
‘Afghan Women United’ দলটি এখন শরণার্থী হিসেবে খেললেও তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট—আবার ফিফা অনুমোদিত আফগানিস্তানের জাতীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া।
ফিফা সূত্রে জানা গেছে, এই টুর্নামেন্টে তাদের পারফরম্যান্স ও সংগঠনের কাঠামো মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে দলটি “Afghanistan (Women in Exile)” নামে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।
ফুটবলের চেয়ে বড় এক জয়
আফগান নারী ফুটবলারদের এই প্রত্যাবর্তন কেবল একটি খেলার জয় নয়; এটি প্রতিরোধ, সাহস ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। তালেবানের নিপীড়নের অন্ধকারে তারা যেভাবে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে, তা গোটা বিশ্বের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
যেমন ফাতিমা হায়দারি বলেছেন—
“আমরা হারিনি। আমরা শুধু অন্য মাঠে ফিরে এসেছি, কিন্তু লড়াইটা একই—নিজের স্বপ্নের জন্য, নিজের দেশের জন্য।”
MAH – 13526 I Signalbd.com



