ফুটবল

বেলিংহামের জাদুতে রিয়াল মাদ্রিদের টানা তিন জয়

Advertisement

ইউরোপের রাজা রিয়াল মাদ্রিদ আবারও দেখাল কেন তারা এখনও মহাদেশীয় ফুটবলের সবচেয়ে ভয়ংকর দল। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া এক রাতে জুড বেলিংহামের একমাত্র গোলে য়্যুভেন্টাসকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে টানা তৃতীয় জয়ে উজ্জ্বল থাকল লস ব্লাঙ্কোসরা।

এ জয়ে রিয়াল এখন গ্রুপ-‘সি’-এর শীর্ষে ৯ পয়েন্ট নিয়ে দৃঢ় অবস্থানে। অন্যদিকে য়্যুভেন্টাসের তৃতীয় ম্যাচে এটি দ্বিতীয় পরাজয়, যা তাদের নকআউট পর্বে জায়গা পাওয়ার লড়াইকে কঠিন করে তুলেছে।

বার্নাব্যুতে ফুটবল উৎসব: রিয়াল বনাম য়্যুভেন্টাস

সান্তিয়াগো বার্নাব্যু মানেই ফুটবলের মন্দির। বৃহস্পতিবার রাতে সেখানে সমবেত হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার দর্শক, যারা অপেক্ষা করছিলেন দুই ইউরোপীয় জায়ান্টের এক রোমাঞ্চকর লড়াই দেখার জন্য। একদিকে ১৪ বারের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ, অন্যদিকে ইতালির গর্ব য়্যুভেন্টাস — ম্যাচের আগেই উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে।

ম্যাচের প্রথম বাঁশি বাজতেই দেখা যায় দুই দলই একে অপরের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। রিয়াল তাদের স্বভাবসুলভ পজেশন-ভিত্তিক ফুটবল খেলতে থাকে, অন্যদিকে য়্যুভেন্টাস পাল্টা আক্রমণে ভরসা রাখে। প্রথম ২০ মিনিটে দু’পক্ষই বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করলেও, শেষ মুহূর্তে দুই দলের গোলরক্ষক — থিবো কোর্তোয়াডি গ্রেগোরি — একের পর এক সেভ করে দলকে বিপদমুক্ত রাখেন।

প্রথমার্ধের নায়ক: কোর্তোয়ার দুর্দান্ত সেভে বেঁচে যায় রিয়াল

প্রথমার্ধের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত আসে ৩৩তম মিনিটে, যখন য়্যুভেন্টাসের ফরোয়ার্ড ফেদেরিকো কিয়েসা বক্সের বাইরে থেকে দারুণ এক শট নেন। বলটি গোলবারের দিকে ছুটে যাচ্ছিল, কিন্তু কোর্তোয়া উড়ে গিয়ে এক হাতে সেটি ঠেকিয়ে দেন। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান এই বেলজিয়ান গোলরক্ষককে।

অন্যদিকে, রিয়ালের জন্য সুযোগ এসেছিল ৪১তম মিনিটে। টনি ক্রুসের ফ্রি-কিক থেকে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের মাথায় ভর করে বলটি গোলবারের খুব কাছে যায়, কিন্তু পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্য ০-০ স্কোরলাইনে।

দ্বিতীয়ার্ধে বদলে যায় দৃশ্যপট: বেলিংহামের জাদুকরী স্পর্শ

দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই রিয়াল মাদ্রিদ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। কোচ কার্লো আনচেলোত্তি দলের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেন। ফলাফল আসে ম্যাচের ৫৭তম মিনিটে।

বা প্রান্ত দিয়ে দারুণ এক দৌড়ে এগিয়ে যান ভিনিসিয়াস জুনিয়র। চারজন য়্যুভেন্টাস ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সে প্রবেশ করে তিনি শক্তিশালী এক শট নেন, যা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফিরে আসা বলটি ঠাণ্ডা মাথায় ট্যাপ ইন করেন জুড বেলিংহাম — বলটি জালের ঠিক উল্টো প্রান্তে গিয়ে লাগে। গোল! বার্নাব্যুতে তখন শুধুই উল্লাস, শোনা যাচ্ছিল একটাই শব্দ — “বেলিংহাম! বেলিংহাম!”

এই গোলে মৌসুমের প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগে গোলের দেখা পেলেন ২২ বছর বয়সী ইংলিশ মিডফিল্ডার, যিনি ইতিমধ্যে লা লিগায় ৭টি গোল করে ফর্মের শিখরে আছেন।

বেলিংহামের উত্থান: তরুণ বয়সেই নেতৃত্বের প্রতীক

জুড বেলিংহামের গল্প আজ শুধু রিয়াল ভক্তদের নয়, পুরো ইউরোপের কাছে অনুপ্রেরণা। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি এখন দলের অন্যতম মূল ভরসা। গত মৌসুমে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফারে রিয়ালে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, এমন তরুণ খেলোয়াড় কি রিয়ালের চাপ সামলাতে পারবে?

কিন্তু সময়ই প্রমাণ দিয়েছে, বেলিংহাম শুধু মানিয়ে নেননি, বরং হয়ে উঠেছেন দলের কেন্দ্রবিন্দু। গোল, অ্যাসিস্ট, নেতৃত্ব — সবকিছুতেই তার উপস্থিতি স্পষ্ট। য়্যুভেন্টাসের বিপক্ষে গোল করার পর তিনি বলেন—

“রিয়ালের হয়ে প্রতিটি ম্যাচ মানে গর্বের বিষয়। আমরা জানতাম, য়্যুভেন্টাস কঠিন প্রতিপক্ষ হবে, কিন্তু আমরা এক দল হিসেবে খেলেছি এবং সেটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।”

ম্যাচের পরিসংখ্যান এক নজরে

পরিসংখ্যানরিয়াল মাদ্রিদয়্যুভেন্টাস
বল দখল৬৪%৩৬%
শট অন টার্গেট
কর্নার
ফাউল১০১২
অফসাইড
গোল

রিয়ালের দখলদারিত্ব এবং শটের সংখ্যাই প্রমাণ করে তারা কতটা আধিপত্য বিস্তার করেছে ম্যাচে।

আনচেলোত্তির কৌশল: অভিজ্ঞতা ও তরুণদের মেলবন্ধন

রিয়ালের ইতালিয়ান কোচ কার্লো আনচেলোত্তি আবারও প্রমাণ করলেন কেন তাকে বিশ্বের সেরা কোচদের একজন বলা হয়। অভিজ্ঞ খেলোয়াড় টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচদের সঙ্গে তরুণ বেলিংহাম, কামাভিঙ্গা, রদ্রিগোদের সমন্বয় করে তিনি তৈরি করেছেন এক নিখুঁত ভারসাম্যপূর্ণ দল।

ম্যাচ শেষে আনচেলোত্তি বলেন—

“এই জয়ের কৃতিত্ব পুরো দলের। বেলিংহাম যেভাবে খেলেছে, তা অসাধারণ। তবে ভিনিসিয়াস ও কোর্তোয়ার অবদানও সমান গুরুত্বপূর্ণ।”

রিয়ালের টানা তিন জয়: চ্যাম্পিয়নস লিগে দাপট

এই জয়ের মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদ এখন টানা তিন ম্যাচে জয় পেয়েছে — যা তাদের গ্রুপ পর্বে এককভাবে শীর্ষে তুলেছে। তারা প্রথম ম্যাচে গালাতাসারেকে ৩-১ ব্যবধানে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে সালজবুর্গকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল।

এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে রিয়াল সহজেই গ্রুপের প্রথম দল হিসেবে নকআউট পর্বে উঠবে, যা ১৮তম মৌসুমে পরপর তাদের গ্রুপ পর্ব থেকে উত্তরণ নিশ্চিত করবে — একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড।


ইতালীয় সংকট: য়্যুভেন্টাসের দুরবস্থা চলছেই

অন্যদিকে য়্যুভেন্টাসের জন্য রাতটি ছিল হতাশার। সিরি-আ লিগে ভালো শুরু করলেও, ইউরোপীয় মঞ্চে তারা একেবারেই ছন্দে নেই। মিডফিল্ডে সৃজনশীলতার অভাব, ডিফেন্সে গতি কম — সব মিলিয়ে রিয়ালের আক্রমণের সামনে তারা প্রায় অসহায় হয়ে পড়ে।

কোচ ম্যাক্স অ্যালেগ্রি বলেন—

“আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু রিয়ালের মানসিক শক্তি অনেক বেশি। তাদের বিপক্ষে সামান্য ভুল মানেই শাস্তি।”

ভক্তদের প্রতিক্রিয়া: সোশ্যাল মিডিয়ায় বেলিংহাম ঝড়

ম্যাচ শেষ হতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেলিংহাম নিয়ে ঝড় বয়ে যায়।
#Bellingham এবং #HalaMadrid হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করতে থাকে এক ঘণ্টার মধ্যেই।

একজন ভক্ত লিখেছেন,

“বেলিংহাম রিয়ালের হৃদস্পন্দন হয়ে উঠেছে।”

আরেকজন মন্তব্য করেন,

“এই ছেলেটা ভবিষ্যতের ব্যালন ডি’অর জয়ী!”

পরবর্তী ম্যাচ: রিয়ালের সামনে চ্যালেঞ্জ লিগা ও পরবর্তী ইউরোপীয় ম্যাচে

রিয়াল মাদ্রিদ আগামী সপ্তাহে লা লিগায় ভিয়ারিয়ালের মুখোমুখি হবে, যেখানে তারা ঘরের মাঠে টানা অপরাজিত থাকার রেকর্ড ধরে রাখতে চাইবে। এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে আবার য়্যুভেন্টাসের মাঠে রিটার্ন লেগে নামবে বেলিংহামরা।

আনচেলোত্তির দল যেভাবে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছে, তা দেখেই বোঝা যায় — ইউরোপের রাজত্ব পুনরুদ্ধারে রিয়াল মাদ্রিদ আগের চেয়েও বেশি প্রস্তুত।

বেলিংহামের স্পর্শে রিয়ালের পুনর্জাগরণ

রিয়াল মাদ্রিদ মানেই ইতিহাস, গৌরব ও জয়ের গল্প। কিন্তু বেলিংহামের আগমনে সেই গল্পে যুক্ত হয়েছে নতুন অধ্যায় — তরুণ নেতৃত্ব, উদ্যম ও আত্মবিশ্বাসের গল্প।

একটি গোলই বদলে দিল ম্যাচের গতিপথ, এবং হয়তো সেই গোলই একদিন হবে এই মৌসুমের টার্নিং পয়েন্ট।

রিয়াল ভক্তদের কাছে এখন একটাই স্লোগান —

“বেলিংহাম আছে, তাই ভয় নেই!”

MAH – 13450 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button