
বার্সেলোনার বিপক্ষে দারুণ এক জয়ের পর যেন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল ফরাসি জায়ান্ট প্যারিস সেন্ট জার্মেইন (পিএসজি)। টানা দুই ম্যাচে ফরাসি লিগ ওয়ানে জয়বঞ্চিত থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। সমর্থকদের মধ্যে হতাশা, মিডিয়ায় প্রশ্ন— “চ্যাম্পিয়নদের কী হলো?”
কিন্তু ইউরোপের বড় মঞ্চে, চ্যাম্পিয়নস লিগে, সেই প্রশ্নের উত্তর মাঠে দিয়েই দিল পিএসজি। বায়ার লেভারকুসেনের মাঠে গিয়ে ৭-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে জিতে নিজেদের চেনা ছন্দে ফিরে এলো তারা।
এই জয়ে দলের হয়ে সবচেয়ে বড় আলোচনায় ছিলেন এক সময়ের ইনজুরি আর সমালোচনায় হারিয়ে যাওয়া উসমান দেম্বেলে। দীর্ঘদিন পর মাঠে ফিরেই যেন নতুন আলো ছড়ালেন তিনি। শুধু গোল নয়, তার তৈরি করা আক্রমণ, গতির ঝলক, বল কন্ট্রোল— সবকিছুতেই ভরপুর এক পারফরম্যান্স উপহার দিলেন ফরাসি এই উইঙ্গার।
প্রথম থেকেই আগ্রাসী পিএসজি
লেভারকুসেনের মাঠ, তাদেরই দর্শক, কিন্তু শুরু থেকেই খেলার নিয়ন্ত্রণ ছিল প্যারিসিয়ানদের হাতে। পিএসজি যেন শুরুতেই জানিয়ে দিল, আজ কোনো ছাড় নেই। ম্যাচের মাত্র সপ্তম মিনিটেই গোল করে বসেন উইলিয়ান পাচো, দেম্বেলের দারুণ এক কর্নার থেকে বল পেয়ে শট নেন তিনি।
এরপর শুরু হয় একের পর এক আক্রমণ। পিএসজির মিডফিল্ডে ভিতিনহা ও ফাবিয়ান রুইজের সমন্বয়, পাশে নুনো মেন্দেজের দৌড়— সবকিছু মিলে লেভারকুসেনের ডিফেন্সকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।
প্রথমার্ধেই তিন গোলের ঝড়
প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই পিএসজির গোল উৎসব শুরু হয়ে যায়। ২৭ মিনিটে দেজিয়ারে দুয়ে দারুণ এক ভলিতে গোল করে ব্যবধান বাড়ান। তার মাত্র সাত মিনিট পরেই স্কোরলাইন হয় ৩-০। এবার গোল করেন জর্জিয়ান ফরোয়ার্ড খভিচা কভারাতশেলিয়া, যিনি সম্প্রতি পিএসজিতে যোগ দিয়েছেন ন্যাপোলি থেকে।
প্রথমার্ধ শেষ হয় ৩-১ গোলে, কারণ বিরতির আগে লেভারকুসেনের পক্ষে একটি সান্ত্বনামূলক গোল করেন অ্যালেইক্স গার্সিয়া।
দ্বিতীয়ার্ধে দেম্বেলের দাপট
বিরতির পর মাঠে নামতেই যেন নতুন রূপে দেখা গেল পিএসজিকে। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু জয় নয়, প্রতিপক্ষকে চূর্ণ করা। দ্বিতীয়ার্ধের ৫২ মিনিটে গোল করেন নুনো মেন্দেজ, দেম্বেলের বানানো নিখুঁত পাস থেকে।
এরপর আসে সেই মুহূর্ত, যেটার অপেক্ষায় ছিলেন পিএসজি সমর্থকরা—
৬১ মিনিটে উসমান দেম্বেলে গোল করেন, এবং পুরো মাঠ যেন উল্লাসে ফেটে পড়ে। তার গোলের পর সতীর্থরা তাকে ঘিরে উদযাপন করে, যেন এই ম্যাচটি তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠল।
৭৪ মিনিটে আবারও গোল করেন ভিতিনহা, দেম্বেলের আরেকটি অ্যাসিস্টে। শেষ দিকে দেজিয়ারে দুয়ে দ্বিতীয় গোল করে নিজের জোড়া পূর্ণ করেন। লেভারকুসেনের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি আবারও করেন অ্যালেইক্স গার্সিয়া, তবে সেটা ছিল শুধুই পরিসংখ্যানের জন্য।
শেষ বাঁশি বাজতেই স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছিল—
বায়ার লেভারকুসেন ২ – ৭ পিএসজি
দুই লাল কার্ডে উত্তেজনা
গোলের সঙ্গে ম্যাচে ছিল উত্তেজনাও। ৭০ মিনিটে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন লেভারকুসেনের রবার্ট আনরিচ ও পিএসজির ইলিয়া জাবারনি। রেফারি VAR দেখে উভয়কে লাল কার্ড দেখান। ফলে উভয় দলই ম্যাচ শেষ করে ১০ জন নিয়ে।
তবে সংখ্যাগত ঘাটতিতেও পিএসজি যেন আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বাকি সময়েও তারা কয়েকবার গোলের সুযোগ তৈরি করে, যা কেবল ভাগ্যের জোরে রক্ষা পায় লেভারকুসেন।
দেম্বেলের ‘কমব্যাক’ গল্প
উসমান দেম্বেলের ক্যারিয়ারটা যেন রোলারকোস্টারের মতো। বার্সেলোনায় চোট, ফর্মহীনতা আর সমালোচনায় ক্লান্ত হয়ে তিনি পিএসজিতে যোগ দেন ২০২৩ সালে। কিন্তু নতুন দলে প্রথম মৌসুমেও চোটের কারণে বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি।
২০২৫ সালের এই ম্যাচে তার প্রত্যাবর্তন যেন প্রতীকী হয়ে দাঁড়াল। গোল করলেন, দুটো অ্যাসিস্ট করলেন, এবং দলের প্রতিটি আক্রমণে তার ছোঁয়া ছিল। ম্যাচ শেষে পিএসজির কোচ লুইস এনরিকে বলেন,
“দেম্বেলে আজ যা খেলেছে, সেটিই আসল দেম্বেলে। সে যখন ফিট থাকে, তখন সে ইউরোপের সেরা উইঙ্গারদের একজন।”
দেম্বেলেও ম্যাচ শেষে আবেগঘন কণ্ঠে বলেন,
“চোটের পর মাঠে ফিরে গোল করা অসাধারণ অনুভূতি। আমি এই ক্লাবের হয়ে আরও অনেক কিছু দিতে চাই।”
সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে যায় প্রশংসার বন্যা।
একজন সমর্থক লিখেছেন,
“আজকের দেম্বেলে ছিল আগুন! মনে হচ্ছিল বার্সেলোনার সোনালি সময়ের নেইমারকে দেখছি।”
অন্য একজন বলেন,
“৭-২ জয়টা শুধু একটা স্কোর নয়, এটা পিএসজির ঘোষণা— আমরা আবার ফিরেছি।”
গ্রুপ টেবিলে পিএসজির অবস্থান
এই জয়ের পর গ্রুপ ‘সি’-তে পিএসজি এখন শীর্ষে উঠে এসেছে ৯ পয়েন্ট নিয়ে।
দ্বিতীয় স্থানে আছে ইন্টার মিলান, যারা একই রাতে ইউনিয়ন সেন্ট-গিলোইসকে ৪-০ গোলে হারিয়েছে।
লেভারকুসেনের অবস্থা এখন বেশ কঠিন। তাদের বাকি ম্যাচগুলোতে জয়ের বিকল্প নেই যদি তারা নকআউট পর্বে যেতে চায়।
ম্যাচ পরিসংখ্যান
সূচক | পিএসজি | লেভারকুসেন |
---|---|---|
বল দখল | ৬৩% | ৩৭% |
অন টার্গেট শট | ১১ | ৪ |
গোল | ৭ | ২ |
কর্নার | ৮ | ৩ |
পাস সফলতা | ৮৮% | ৭৬% |
লাল কার্ড | ১ | ১ |
কেন পিএসজি এত ভয়ংকর ছিল?
এই ম্যাচে পিএসজির সাফল্যের পেছনে তিনটি মূল কারণ ছিল—
- মিডফিল্ড কন্ট্রোল: ভিতিনহা ও ফাবিয়ান রুইজের দারুণ সমন্বয় লেভারকুসেনকে মাঝমাঠে দাঁড়াতেই দেয়নি।
- উইং আক্রমণ: দেম্বেলে ও মেন্দেজ— দু’জনের গতি ও ক্রস থেকে এসেছে তিনটি গোল।
- রক্ষণে দৃঢ়তা: যদিও দুই গোল হজম করেছে, কিন্তু মারকুইনিয়োসের নেতৃত্বে রক্ষণভাগ সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল ছিল।
ইউরোপীয় ফুটবলে নতুন বার্তা
এই জয় শুধু একটি ম্যাচ নয়, বরং পিএসজির জন্য এক নতুন বার্তা— তারা এখনো ইউরোপের বড় শক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে লিগে কিছু হোঁচট খাওয়া তাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত করেছিল, কিন্তু এই ম্যাচে তারা প্রমাণ করল, সেরা দিনে তারা যেকোনো প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতে পারে।
গোল বন্যার এই ম্যাচে দেম্বেলের প্রত্যাবর্তন ছিল পিএসজির নতুন যুগের সূচনা। তাদের খেলা ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর, আক্রমণ ছিল ঝড়ের মতো, আর প্রতিপক্ষের কাছে এক শিক্ষা— কখনোই পিএসজিকে হালকা করে দেখা যায় না।
আগামী ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ হবে ইন্টার মিলান। দুই দলই দুর্দান্ত ফর্মে আছে। সুতরাং ফুটবলপ্রেমীদের সামনে অপেক্ষা করছে আরেকটি মহারণ।
সারসংক্ষেপ:
- পিএসজি ৭–২ গোলে লেভারকুসেনকে হারাল
- দেম্বেলের প্রত্যাবর্তনে গোল ও দুই অ্যাসিস্ট
- দেজিয়ারে দুয়ের জোড়া গোল
- দুই লাল কার্ডে উত্তেজনা
- চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ ‘সি’-তে শীর্ষে পিএসজি
MAH – 13421 I Signalbd.com