
ফুটবল মানেই আবেগ, ফুটবল মানেই অজানাকে জয় করার সাহস। এই সাহসী অভিযানে ইতিহাস গড়েছে আফ্রিকার দেশ মরক্কো। ফুটবলপ্রেমীদের চমকে দিয়ে তারা পরাজিত করেছে বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তি আর্জেন্টিনাকে, আর সেই সঙ্গে নিজেদের নাম লিখেছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের কাতারে।
চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর ঐতিহাসিক এস্তাদিও ন্যাসিওনাল জুলিও মার্টিনেজ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ফিফা অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের রোমাঞ্চকর ফাইনাল। হাজার হাজার দর্শকের চোখের সামনে মরক্কো ২–০ গোলে হারিয়ে দেয় আর্জেন্টিনাকে, যারা এর আগে ছয়বার এই আসরের শিরোপা জিতেছিল।
ইয়াসির জাবিরির জোড়া গোল, আফ্রিকার নতুন নায়ক
মরক্কোর এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের মূল কারিগর তরুণ ফরোয়ার্ড ইয়াসির জাবিরি। ম্যাচের শুরুতেই তার পায়ের যাদুতে এগিয়ে যায় মরক্কো। খেলার মাত্র ১২তম মিনিটেই দুর্দান্ত এক গোল করেন জাবিরি। বাম দিক থেকে আসা ক্রসটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিখুঁত ভলিতে বল জড়িয়ে দেন আর্জেন্টিনার জালে।
গোল খাওয়ার পর আর্জেন্টিনা কিছুটা চাপে পড়ে যায়। মধ্যমাঠে তারা বলের দখল রাখলেও মরক্কোর শক্ত রক্ষণভাগ তাদের গোলের সুযোগ দিতে চায়নি। বরং আক্রমণে নামলেই মরক্কো দেখিয়েছে গতি ও কৌশলের নিখুঁত সমন্বয়।
প্রথম গোলের ১৭ মিনিট পর, অর্থাৎ ম্যাচের ২৯তম মিনিটে আবারও গোল করেন ইয়াসির জাবিরি। এবার বল পেয়েই বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শটে জালে পাঠান বল। সেই মুহূর্তে পুরো স্টেডিয়াম যেন কেঁপে ওঠে ‘মরক্কো মরক্কো’ ধ্বনিতে।
আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ
আর্জেন্টিনা ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে চেয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল সপ্তমবারের মতো অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপ জয় করা। দলের হয়ে খেলার মাঠে ছিলেন তরুণ তারকা লুকাস রদ্রিগেজ, যাকে অনেকেই নতুন মেসি বলে ডাকেন। কিন্তু মরক্কোর রক্ষণভাগ এতটাই সংগঠিত ছিল যে, একের পর এক আক্রমণেও গোলের দেখা পাননি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডরা।
দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা মরিয়া হয়ে ওঠে ফিরে আসার জন্য। বল দখলে এগিয়ে থেকেও তাদের আক্রমণ ভেঙে দেয় মরক্কোর ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক ইউসুফ বেন নাসের। শেষ মুহূর্তে দুটি নিশ্চিত সুযোগ নষ্ট করেন আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড দিয়েগো রিয়েল, ফলে হতাশ হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় আলবিসেলেস্তেদের।
মরক্কোর ফুটবলে নতুন অধ্যায়
এই জয় শুধু একটি ম্যাচের নয়, এটি পুরো আফ্রিকা মহাদেশের গর্বের জয়। ফিফা অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপে মরক্কোর এটি ছিল প্রথম শিরোপা। এর আগে তারা কখনও সেমিফাইনালের বেশি যেতে পারেনি। কিন্তু এবার ইতিহাস বদলে দিয়েছে এই প্রজন্ম।
ফাইনালের পর মরক্কোর অধিনায়ক ওথমান মামা বলেন,
“আমরা জানতাম, আর্জেন্টিনাকে হারানো সহজ নয়। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ফুটবল খেলাটা উপভোগ করা। এই ট্রফি আমাদের দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য, যারা স্বপ্ন দেখে একদিন বিশ্বজয় করার।”
জাবিরি – মেসির ভক্ত থেকে নায়ক হয়ে ওঠা
ইয়াসির জাবিরি ছোটবেলা থেকেই লিওনেল মেসির অনুরাগী। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে মেসির খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এবার সেই আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধেই ফাইনালে জোড়া গোল করে যেন নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি।
টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে জাবিরি করেছেন মোট ৫ গোল। যদিও গোল্ডেন বুট জিততে পারেননি, তবুও পান ‘সিলভার বল’ পুরস্কার। তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে মরক্কো পেয়েছে প্রথমবারের মতো বিশ্ব শিরোপা।
টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও পুরস্কার তালিকা
- গোল্ডেন বল (সেরা খেলোয়াড়) – মরক্কোর ওথমান মামা
- সিলভার বল (দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়) – মরক্কোর ইয়াসির জাবিরি
- গোল্ডেন গ্লাভস (সেরা গোলরক্ষক) – আর্জেন্টিনার সান্তিনো বার্বি
- গোল্ডেন বুট (সর্বোচ্চ গোলদাতা) – ব্রাজিলের লুইজ ফেরেইরা (৬ গোল)
এই পুরস্কারগুলো প্রমাণ করে, এ বছরের অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপে মরক্কোর খেলোয়াড়রা নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন।
বিশ্ব ফুটবলে নতুন তারকারা
ফিফা অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপ সবসময়ই তরুণ প্রতিভা তুলে ধরার মঞ্চ হিসেবে পরিচিত। এখান থেকেই বিশ্বের সেরা তারকারা উঠে এসেছেন। অতীতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসি, পল পগবা, আর্লিং হালান্ড— সবাই এই মঞ্চ থেকেই পরিচিত হয়েছেন বিশ্বমঞ্চে।
এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো মরক্কোর ইয়াসির জাবিরির নাম। ফুটবল বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি তিনি এভাবে খেলে যান, তাহলে খুব শিগগিরই ইউরোপের বড় কোনো ক্লাবে দেখা যেতে পারে এই তরুণ প্রতিভাকে।
মরক্কোর জয়, আফ্রিকার ফুটবলে নতুন আশা
আফ্রিকার ফুটবল সবসময়ই শক্তিশালী হলেও বড় টুর্নামেন্টে তাদের জয় বিরল। মরক্কোর এই সাফল্য মহাদেশটির তরুণ ফুটবলারদের মাঝে নতুন অনুপ্রেরণা জাগাবে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, মরক্কোর ফুটবল একাডেমিগুলোতে এখন উৎসবের আমেজ।
জাতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি বলেন,
“এই জয় শুধু মরক্কোর নয়, পুরো আফ্রিকার জয়। আমরা প্রমাণ করেছি, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম থাকলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।”
আর্জেন্টিনার হতাশা, তবু ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল
আর্জেন্টিনা এই পরাজয়ে হতাশ হলেও তাদের কোচ হুয়ান সান্তোস জানিয়েছেন,
“আমরা হারলেও গর্বিত। এই দলটি খুব তরুণ, সামনে তাদের জন্য অনেক সুযোগ অপেক্ষা করছে।”
আর্জেন্টিনার এই দলে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলার আছেন যারা ভবিষ্যতে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারেন।
সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মরক্কোর সমর্থকরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে ‘#MoroccoChampions’ হ্যাশট্যাগে ভরে যায়। অনেকেই লিখেছেন, “এটি আফ্রিকার মুহূর্ত, এটি ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।”
বিশ্বমঞ্চে মরক্কোর উত্থান
গত কয়েক বছরে মরক্কোর ফুটবল ধারাবাহিক উন্নতির প্রমাণ দিয়েছে। ২০২২ বিশ্বকাপে তাদের সিনিয়র দল সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল, যা আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম। এবার অনূর্ধ্ব–২০ পর্যায়ে তারা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
ফুটবল বিশ্লেষকরা বলছেন, মরক্কো এখন বিশ্ব ফুটবলে নতুন শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে। উন্নত প্রশিক্ষণ, আধুনিক অবকাঠামো এবং তরুণ প্রতিভা বিকাশে তাদের পরিকল্পনা সফল হচ্ছে।
চিলির আকাশে যখন মরক্কোর পতাকা উড়ছিল, তখন ফুটবলের ইতিহাসে লেখা হচ্ছিল এক নতুন অধ্যায়। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে মরক্কো শুধু ট্রফিই জেতেনি, জিতেছে কোটি মানুষের হৃদয়।
এই জয় ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে—যে কোনো ছোট দেশও বড় স্বপ্ন দেখলে ইতিহাস লেখা সম্ভব।
MAH – 13394 I Signalbd.com