আর্জেন্টিনায় বিদায়ী ম্যাচে জোড়া গোল করে চোখের জলে ভাসালেন লিওনেল মেসি

ফুটবলের শেষ অধ্যায় লিখলেন দেশের মাঠে
ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের একজন, লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। যাকে পুরো বিশ্ব চেনে ভালোবেসে ‘লিও’, ‘লা পুলগা’, বা ‘গোট’ (Greatest of All Time) নামে। সেই মেসির আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেশের মাটিতে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ হয়ে গেল বুয়েনস এইরেসের ঐতিহাসিক মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে।
২০২৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার ভোরে বাংলাদেশ সময় সাড়ে পাঁচটায় আর্জেন্টিনা নামল ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে। ম্যাচ শুরুর আগেই সবাই জানত, এটি হতে যাচ্ছে মেসির দেশের মাটিতে শেষ ম্যাচ। তাই গ্যালারিতে ছিল না শুধু ভক্তদের উন্মাদনা—সাথে ছিলেন মেসির স্ত্রী আন্তোনেলা, তিন সন্তান, আত্মীয়স্বজন এবং অগণিত সমর্থক।
স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উপস্থিত প্রায় ৮০ হাজার দর্শক সাক্ষী থাকলেন এক ইতিহাসের।
মেসির জোড়া গোল, আর্জেন্টিনার জয়
মেসি জানতেন—এই বিদায়ী ম্যাচ গোল ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই যেন ভাগ্যকেও পাশে পেলেন।
- প্রথম গোল:
প্রথমার্ধের শেষের ঠিক আগে, হুলিয়ান আলভারেজের অসাধারণ পাস পেয়ে মেসি তার স্বাক্ষর ‘চিপ শট’ দিয়ে গোল করেন। গ্যালারিতে তখন শুধু উল্লাস, কান্না আর করতালি। - দ্বিতীয় গোল:
৭৬ মিনিটে মেসির ফ্রি-কিক থেকে তৈরি আক্রমণে লাওতারো মার্টিনেজ গোল করেন, আর্জেন্টিনা ২-০ তে এগিয়ে যায়। চার মিনিট পর থিয়াগো আলমাদার সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়ায় মেসি সহজ এক ট্যাপ-ইনে গোল পূর্ণ করেন। সেটিই তার জোড়া গোল।
শেষ দিকে হ্যাটট্রিকের সুযোগ এলেও অফসাইডের কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। তবুও মেসির জোড়া গোল আর এক অ্যাসিস্টে আর্জেন্টিনা ৩-০ ব্যবধানে ভেনেজুয়েলাকে হারিয়ে মাঠ ছাড়ে।
মেসির রেকর্ড ভাঙা ক্যারিয়ার
এই গোলগুলোর মাধ্যমে মেসি নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছেন:
- চলতি বাছাইপর্বে সর্বোচ্চ গোলদাতা → ৭ গোল
- বিশ্বকাপ বাছাই ইতিহাসে গোল → ৩৫
- আর্জেন্টিনার হয়ে মোট আন্তর্জাতিক গোল → ১১৪
- এর মধ্যে ১০০টি গোল এসেছে বাম পায়ে
- আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা (ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর)
পরিবারের সঙ্গে আবেগঘন মুহূর্ত
জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় মেসির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার তিন ছেলে। গ্যালারিতে ছিলেন স্ত্রী আন্তোনেলা। প্রতিটি গোলের পর ক্যামেরা ধরা দিয়েছে তাদের হাসি-কান্নার মিশ্র আবেগ। মেসি বারবার তাকাচ্ছিলেন গ্যালারির দিকে—যেন বলছিলেন, “সবই তোমাদের জন্য।”
আনন্দ নাকি কান্না?
ভক্তরা গান ধরেছিল—
“লিও মেসি আছে পাশে, পুরো পথ আমরা পাড়ি দেব একসঙ্গে।”
কিন্তু ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের চারপাশে ছিল চোখের পানি, কান্না আর আবেগের ঢেউ। মেসি নিজেও যেন আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন। বিদায়ী ম্যাচে জোড়া গোল করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন— শেষ অধ্যায়ও হবে সোনালি, যেমনটা তার সমগ্র ক্যারিয়ার।
মনুমেন্তালের ইতিহাস ও মেসির যাত্রা
২০০৫ সালে, ২০ বছর বয়সী তরুণ মেসি প্রথমবার আর্জেন্টিনার জার্সি পরে মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে নামেন। সেখানেই শুরু হয়েছিল স্বপ্নযাত্রা।
দুই দশক পর, সেই একই মাঠে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতায় শেষ অধ্যায় লিখলেন তিনি। একদম শুরু থেকে শেষ—সবকিছু যেন বৃত্তের মতো পূর্ণ হলো।
বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
মেসির বিদায়ী ম্যাচ ঘিরে শুধু আর্জেন্টিনায় নয়, পুরো পৃথিবীতে আলোচনা চলছে।
- স্পেনের মার্কা লিখেছে: “মেসি শুধু ফুটবল খেলেন না, তিনি ইতিহাস রচনা করেন।”
- ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম বলেছে: “একজন ব্রাজিলিয়ান সমর্থক হয়েও আজ মেসিকে কুর্নিশ জানাই।”
- বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে #GraciasMessi হ্যাশট্যাগে।
মেসির ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো
- ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা বার্সেলোনার হয়ে।
- ৭টি ব্যালন ডি’অর, যা বিশ্ব রেকর্ড।
- কোপা আমেরিকা ২০২১ জয় করে আর্জেন্টিনাকে ট্রফি এনে দেন।
- ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ – ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন।
- আর্জেন্টিনার হয়ে ১১৪ গোল, ৫০টির বেশি অ্যাসিস্ট।
সামনে কী?
আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর ইকুয়েডরের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচ দিয়ে আর্জেন্টিনার বাছাই মিশন শেষ হবে। তবে সেটি দেশের মাঠ নয়। ফলে এই ম্যাচই ছিল আর্জেন্টিনার মাটিতে মেসির শেষ নাচ।
লিওনেল মেসির বিদায়ী রাত কেবল ফুটবল ম্যাচ ছিল না—এটি ছিল এক ইতিহাস, এক আবেগ, এক কবিতা।
যেন আর্জেন্টিনার প্রতিটি হৃদয় বলছিল:
“ধন্যবাদ লিও, ধন্যবাদ আমাদের জন্য এত কিছু দেওয়ার জন্য।”
আজকের মনুমেন্তাল রাত আর্জেন্টিনা ও বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসে চিরকাল খোদাই হয়ে থাকবে।
MAH – 12642, Signalbd.com