বানিজ্য

পুঁজিবাজারে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের ফলে সর্বস্ব হারিয়ে পথে নেমেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজারে নেমে আসা এই ভয়াবহ পতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে বিক্ষোভ ও প্রতীকী কফিন মিছিল করেন। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, তারা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি না মানলে আরও কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

বিক্ষোভে উত্তাল মতিঝিল, নেতৃত্বে বিনিয়োগকারী সংগঠন

এই বিক্ষোভের আয়োজন করে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের ব্যানারে মতিঝিলে জড়ো হন শতাধিক বিনিয়োগকারী। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন, মুখপাত্র ও সমন্বয়ক নুরুল ইসলাম মানিকসহ অন্যান্য নেতারা।

বিনিয়োগকারীরা কালো ব্যানার ও কফিন নিয়ে শ্লোগান দিতে থাকেন—”আমার টাকা ফেরত চাই”, “ব্যর্থ কমিশনের পদত্যাগ চাই”, “শেয়ারবাজার বাঁচাও, বিনিয়োগকারীদের মর্যাদা দাও” ইত্যাদি। কফিন মিছিলের মাধ্যমে তারা প্রতীকীভাবে দেখিয়েছেন, পুঁজিবাজারে অব্যাহত পতনে তাদের পুঁজি যেন কবরস্থ হয়ে গেছে।

দাবি: পদত্যাগ ও অপসারণ

বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেন। পাশাপাশি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদকে অপসারণ করার আহ্বান জানানো হয়।

তাদের অভিযোগ—দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারে কাঠামোগত দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও সঠিক তদারকির ঘাটতি রয়েছে। অথচ বিএসইসি ও আইসিবি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বড় বড় কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলেও বাজারে আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম, না মানলে কঠোর কর্মসূচি

বিনিয়োগকারীরা জানিয়ে দেন, তাদের দাবি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে না মানলে তারা অবস্থান কর্মসূচি, অনশন ও আরও বড় আন্দোলনের দিকে যাবেন। সংগঠনের মুখপাত্র নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, “এই বাজারে এখন বিনিয়োগকারী মানেই লোকসানের অন্য নাম। কমিশনের ব্যর্থতা আজ কোটি কোটি বিনিয়োগকারীর স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আর প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না। এবার চাই পদক্ষেপ। না হলে মতিঝিলসহ দেশের প্রতিটি শহরে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে।”

দরপতনের প্রেক্ষাপট: আস্থা সংকট, নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট, সুদের উচ্চ হার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করেছে। এতে বাজার থেকে পুঁজি প্রত্যাহারের প্রবণতা বাড়ছে।

গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ধারাবাহিকভাবে নিচে নেমেছে। অনেক মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫-১০% পর্যন্ত কমে গেছে, এমনকি কিছু শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে ব্যাপক লোকসান গুনতে হচ্ছে।

বাজারে সুশাসনের অভাব ও অনিয়মের অভিযোগ

বিনিয়োগকারীদের বড় অভিযোগ হলো—শেয়ারবাজারে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যথাযথ নজরদারি করছে না। আইপিওতে অতিমূল্যায়ন, স্বচ্ছতা না থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সদিচ্ছার অভাব এবং বড় বিনিয়োগকারীদের পেছনে সরকারের নীরব ভূমিকা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসন ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বাজারে আস্থা ফিরে আসা কঠিন।

আইসিবি’র কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

বিনিয়োগকারীদের অন্যতম অভিযোগ হলো—পুঁজিবাজারে সংকটকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকারী সংস্থা আইসিবি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের মতে, আইসিবি যদি বিপর্যয়ের সময় বাজারে তারল্য সরবরাহ করত, তাহলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। এই কারণে আইসিবির চেয়ারম্যানের অপসারণ চাওয়া হয়েছে।

সমাধানে কী লাগবে? বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, “আমাদের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকটে ভুগছে। প্রতিটি পতনের পর বিনিয়োগকারীরা যদি এইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং কোনো নিয়ন্ত্রক জবাবদিহি না করে, তাহলে এই বাজারে কেউ থাকবে না।”

তিনি আরও বলেন, “দ্রুত সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। বাজারে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়া এই পতন থামবে না।”

বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ: সরকার হস্তক্ষেপ করুক

অনেক বিনিয়োগকারী সরাসরি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা চায় প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করুন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইসিবি-তে দক্ষ ও দায়বদ্ধ নেতৃত্ব নিয়ে আসুন।

একজন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজারে টাকা রেখেছি, এখন সব শেষ। আমরা চাই না, আরও কেউ এই ফাঁদে পড়ুক।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button