ঢাকায় সন্ধা-রাতে-ভোরে ছিনতাইয়ের আশঙ্কা বেশি,৩ মাসে ১১০৮ আসামি জামিনে মুক্ত

ঢাকায় ছিনতাই আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা, গভীর রাত ও ভোরে এ আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই পরিস্থিতিতে গত তিন মাসে রাজধানীর ছিনতাই মামলার ১ হাজার ১০৮ আসামি আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এতে জনমনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ছিনতাইয়ের ঝুঁকি কোন সময়ে বেশি
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটে তিন সময়ে—সন্ধ্যা, গভীর রাত ও ভোরে। এ সময় পথচারীরা একা চলাফেরা করলে কিংবা রাস্তায় যানজট না থাকলে ছিনতাইকারীরা সহজে সুযোগ নেয়।
শুধু পকেটমার নয়, অনেক সময় ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে নগদ অর্থ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কারসহ অন্যান্য জিনিস লুট করে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলে করে এসে হঠাৎ হামলা চালিয়ে পথচারীদের জখম করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা বাড়ছে।
তিন মাসে জামিনে মুক্ত ১১০৮ আসামি
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মে, জুন ও জুলাই মাসে ঢাকায় ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মোট ১ হাজার ১০৮ আসামি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
- মে মাসে জামিন পেয়েছেন ৪২৫ জন
- জুন মাসে জামিন পেয়েছেন ৩০৫ জন
- জুলাই মাসে জামিন পেয়েছেন ৩৭৮ জন
এরা ডিএমপির ৫০টি থানায় দায়ের হওয়া প্রায় ১,০৫৮টি মামলার আসামি ছিলেন। এর মধ্যে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ ছিল, কেউ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন, আবার অনেককে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের পর ছিনতাই বেড়ে যাওয়া
গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়ে যায়। এই সুযোগে বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সেই সময় একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ছিনতাইকারীদের হাতে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন তরুণ মো. আরমান হোসেন। পরিবার জানায়, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ার কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়।
এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথ অভিযান চালায়। একসময় অনেক অপরাধী গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে।
আদালত ও প্রসিকিউশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের দীর্ঘদিন আটক রাখা সম্ভব হয় না, তাই জামিন পাওয়ার সুযোগ থাকে। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হলো প্রকৃত অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করা।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী জানিয়েছেন, সন্দেহভাজন আসামিদের ক্ষেত্রে সাধারণত পাঁচ-ছয় মাস পর জামিন হয়ে যায়। আবার যারা হাতেনাতে ধরা পড়ে বা যাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া কঠিন হয়।
তবে অভিযোগ উঠেছে, অনেক সময় প্রসিকিউশন পর্যাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে না। আবার পুলিশও সঠিক ধারায় মামলা না নিয়ে পুরোনো মামলায় আসামিকে গ্রেপ্তার দেখায়, ফলে আদালতে তাদের অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ: কারা জামিন পাচ্ছেন
তথ্য অনুযায়ী, জামিন পাওয়া আসামিদের মধ্যে অনেকে সরাসরি এজাহারভুক্ত।
- জুলাই মাসে জামিন পাওয়া ৩৭৮ জনের মধ্যে ১৪৮ জন ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি।
- জুনে জামিন পাওয়া ৩০৫ জনের মধ্যে ১৫০ জন ছিলেন এজাহারভুক্ত।
- মে মাসে জামিন পাওয়া ৪২৫ জনের মধ্যে ১৩১ জন ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি।
এছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া কিংবা তদন্তে নাম আসা ব্যক্তিরাও মুক্তি পেয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য
পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক কষ্টে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এতে একই অপরাধীর পেছনে বারবার পুলিশকে পরিশ্রম করতে হয়।
আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, প্রকৃত অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সঠিক ধারায় মামলা করতে হবে এবং অভিযোগপত্র দ্রুত দিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদেরও আদালতে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
জননিরাপত্তা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অপরাধীরা বারবার জামিনে বের হয়ে গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় আরও বেড়ে যায়।
শহরে রাতের বেলা স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। অনেক এলাকায় স্থানীয়ভাবে মানুষ পাহারার ব্যবস্থা করছে, যা আবারও জননিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা প্রকাশ করছে।
সংক্ষিপ্তসার
ঢাকায় ছিনতাই সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশের তদন্ত, মামলার সঠিক ধারা ও আদালতে শক্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না হলে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের সমন্বিত পদক্ষেপ কত দ্রুত কার্যকর হবে?
এম আর এম – ০৯২৪, Signalbd.com