আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৭১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ পুরো পরিবার। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হেরাতের গুজারা এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস, একটি মোটরসাইকেল এবং একটি জ্বালানিবাহী ট্রাকের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায় ট্রাকে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাসের যাত্রীদের অধিকাংশ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
হেরাত প্রাদেশিক পুলিশের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ সাইদি জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাটি ঘটে যখন ইরান থেকে কাবুলগামী একটি যাত্রীবাহী বাস বেপরোয়া গতিতে চলছিল। প্রথমে বাসটি একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা মারে। এর কিছুক্ষণ পর সেটি বিপরীত দিক থেকে আসা একটি জ্বালানিবাহী ট্রাকের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায়। এতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুনে মুহূর্তেই বাসের ভেতরে থাকা যাত্রীরা আটকা পড়ে যায়।
নিহতদের মধ্যে ট্রাকচালক, তার সহকারী এবং মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রী—এই চারজন ছাড়া বাকিরা সবাই বাসের যাত্রী। সাইদি আরও জানিয়েছেন, বাসের মাত্র তিনজন যাত্রী জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন, তবে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
নিহতদের মধ্যে শরণার্থী পরিবারের সদস্যরা
দুর্ঘটনায় নিহতদের অনেকেই ছিলেন আফগান শরণার্থী, যারা ইরানে দীর্ঘদিন বসবাস করার পর সম্প্রতি দেশে ফিরছিলেন। গত শতকের আশির দশকে সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় লাখো আফগান ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সম্প্রতি ইরান সরকার আফগান শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি আফগান ইরান থেকে ফিরেছেন। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যারা বাধ্য হয়ে আফগানিস্তানে ফিরছিলেন।
ভয়াবহতা ও মানবিক বিপর্যয়
সাক্ষীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষের পর বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে চারপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে আসে। তবে আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃতদের অনেকের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তাদের পরিচয় শনাক্ত করতেও কর্তৃপক্ষের সমস্যা হচ্ছে।
স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে আহতদের নেওয়া হলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অধিকাংশের অবস্থা গুরুতর।
আফগানিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র
আফগানিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। দেশটির দুর্বল অবকাঠামো, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, পুরনো যানবাহন এবং চালকদের অসতর্কতা মিলিয়ে প্রায়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। শুধু গত বছর ডিসেম্বরেই একটি জ্বালানিবাহী ট্যাংকার ট্রাকের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে ৫২ জন নিহত হয়েছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক না থাকা, যথাযথ ট্রাফিক আইন প্রয়োগ না হওয়া এবং প্রশিক্ষিত চালকের অভাবই এসব মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় আফগানিস্তানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষজন নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন। জাতিসংঘ আফগানিস্তান মিশন (UNAMA) এক বিবৃতিতে বলেছে, “হেরাতের দুর্ঘটনা আমাদের গভীরভাবে মর্মাহত করেছে। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।”
সরকারের উদ্যোগ
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে। চালকের বেপরোয়া গতি ও অসতর্কতাকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হলেও আরও বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সহায়তায় জরুরি তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছে।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, শুধু সহায়তা নয়, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রথমেই উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কঠোর ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতেই থাকবে।
হেরাতের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা শুধু আফগানিস্তানের নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক সতর্কবার্তা। নিরাপদ সড়ক, সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং মানবিক দায়িত্ববোধ ছাড়া প্রতিদিনই এমন অসংখ্য প্রাণ অকারণে ঝরে যাবে। নিহতদের পরিবারগুলো যে শোক ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কোনো সহানুভূতিতেই পূরণ হওয়ার নয়।
MAH – 12416 , Signalbd.com



