মার্কিন শুল্কনীতিতে গৃহস্থালি পণ্যের দাম বৃদ্ধি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহস্থালি পণ্যের দাম নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ভোক্তারা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের খরচ সামাল দেওয়া এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি, বৈশ্বিক সরবরাহ–ব্যবস্থার অস্থিরতা এবং জলবায়ু–সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করছেন।
ভোক্তা মূল্য সূচক বাড়ছে, তবে গতি কিছুটা কম
সরকারি পরিসংখ্যান এখনও প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু রয়টার্স ও ব্লুমবার্গের জরিপে দেখা যাচ্ছে—জুলাই ২০২৫–এ ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) প্রায় ০.২% বৃদ্ধি পেতে পারে। জুনে এই হার ছিল ০.৩%। অর্থাৎ বৃদ্ধি এখনও হচ্ছে, তবে গতি সামান্য কমেছে।
জুলাইয়ের তথ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ট্রাম্পের নতুন “পারস্পরিক” শুল্কনীতি চালুর আগের শেষ পূর্ণ মাসের পরিসংখ্যান। ৭ আগস্ট থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব বাজারে আগেই পড়তে শুরু করেছে।
শুল্কনীতির প্রভাব: অর্থনীতিবিদদের সতর্কবার্তা
গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণ বলছে—ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কের কারণে আগামী কয়েক মাসে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে। তাদের অনুমান, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়াবে ৩.৩%–এ, যা শুল্ক ছাড়া ২.৫% হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ, শুল্কের কারণে প্রায় ০.৮ শতাংশ পয়েন্ট অতিরিক্ত চাপ পড়বে বাজারে।
ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন—গৃহস্থালি পণ্যের দাম কমানো হবে, যাতে সাধারণ মার্কিন পরিবারগুলো স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচনের পরও পণ্যের দাম বাড়ছেই। এর ফলে ক্রেতাদের কেনাকাটার অভ্যাস বদলে যাচ্ছে; তারা ছোট পরিমাণে কিনছেন, কুপন ব্যবহার করছেন এবং অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বাদ দিচ্ছেন।
জরিপে ভোক্তাদের উদ্বেগ
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস–এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে—৫৩% মার্কিনি গৃহস্থালি পণ্যের দামকে ‘বড় ধরনের চাপ’ হিসেবে দেখছেন, ৩৩% বলছেন ‘মাঝারি চাপ’। মাত্র ১৪% বলছেন, এতে তাদের তেমন প্রভাব পড়ছে না।
এটি প্রথমবারের মতো একটি বড় জরিপ যেখানে মার্কিনিদের দৈনন্দিন খরচের মানসিক চাপ সরাসরি মাপা হয়েছে।
কোন কোন পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে?
২০২২ সালে সরবরাহ–সংকটে গৃহস্থালি পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি ছিল প্রায় ৯.৪%। বর্তমানে তা জুন পর্যন্ত বছরে ২.৪%–এ নেমে এসেছে, তবে দাম কমেনি। বরং ডিম, গরুর মাংস, কমলার রসের দাম বেড়েছে—যার পেছনে আছে জলবায়ুর প্রভাব ও সরবরাহে ঘাটতি।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতির কারণে বিদেশি ফল, কফি, টিনজাত খাবারসহ আমদানি–নির্ভর পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে।
কর্মসংস্থানে ধীরগতি
মার্কিন ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস জানিয়েছে—জুলাইয়ে মাত্র ৭৩ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রত্যাশার (৮০ হাজার–১ লাখ) চেয়ে কম। এর মানে কর্মসংস্থান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারছে না, যা অর্থনীতির জন্য খারাপ সংকেত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিনিয়োগ কমে গেলে ভবিষ্যতে বেকারত্বের হার বাড়তে পারে এবং বাজারে খরচ আরও কমবে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিদেশি পণ্য কম কিনছেন। মার্কিন জনশুমারি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুনে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন—গ্রাহকরা এখন শুধু জরুরি জিনিস কিনছেন এবং বাইরে খাওয়ার বদলে ঘরে রান্না করছেন।
বড় ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের পণ্যে ছাড় দিচ্ছে, নতুন সস্তা ব্র্যান্ড বাজারে আনছে এবং প্রচারণায় বেশি জোর দিচ্ছে।
খাবার ও পানীয় শিল্পে প্রভাব
ওরিও ও চিপস আহয়ের মালিক প্রতিষ্ঠান মন্ডেলেজ জানিয়েছে—মানুষ এখন স্ন্যাকস কম কিনছে। উত্তর আমেরিকায় তাদের বিক্রি গত প্রান্তিকে ৩.৫% কমেছে। সিইও ডির্ক ভ্যান দে পুট বলেছেন—মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে গ্রাহকদের উদ্বেগ বিক্রিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক প্রভাব
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বৈশ্বিক বাজারও এ প্রভাব অনুভব করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বেশি শুল্ক আরোপ করে, তাহলে অন্যান্য দেশও পাল্টা শুল্ক দিতে পারে—যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরও ব্যয়বহুল করবে। বিশেষ করে কৃষি পণ্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে এই প্রভাব বেশি পড়তে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন—যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৬ সালের শুরুতেই ভোক্তা আস্থা আরও কমে যেতে পারে। মজুত শেষ হয়ে গেলে এবং ব্যবসায়ীরা শুল্কের অতিরিক্ত খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপালে দাম দ্রুত বাড়তে পারে।
এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন–আয়ের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহস্থালি পণ্যের বাজার এখন বড় ধরনের অস্থিরতার মুখে। শুল্কনীতি, বৈশ্বিক সরবরাহ–সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কর্মসংস্থানের ধীরগতির সমন্বয়ে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি চাপ অনুভব করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল দাম কমানো, কিন্তু বাস্তবে তা বাড়ছে—যা আগামী দিনে মার্কিন অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
MAH – 12263 , Signalbd.com