ক্রিকেট

কাঠমিস্ত্রি থেকে অ্যাশেজ তারকা: ডগেটের অবিশ্বাস্য উত্থান

Advertisement

পার্থের রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রেন্ডান ডগেট যেন তাঁর পুরো জীবনটাকেই আরেকবার চোখের সামনে দেখতে পেলেন। একসময় তোওউম্বার এক তরুণ কার্পেন্টার—যার প্রতিদিনের শুরুর কাজ ছিল কাঠ কাটা, মেপে ফ্রেম বানানো, বাড়ির কাঠামো দাঁড় করানো। দিনভর কঠিন পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যায় ব্যাট-বল হাতে নেওয়াই ছিল তাঁর আরেক পৃথিবী। আর সেই তরুণই আজ অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলের সামনে এক নতুন সম্ভাবনা। অ্যাশেজ সিরিজের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপ।

এ যেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে আরেক রূপকথা।

কখনো কেউ ভাবেনি—যে ছেলেটি কাঠমিস্ত্রির হাতুড়ি আর করাত হাতে নিয়ে বড় হয়েছে, সেই হবে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলের পেস আক্রমণের অন্যতম মুখ। কিন্তু ঠিক সেই ঘটনাই বাস্তবের পথে হাঁটছে।

অপ্রত্যাশিত সুযোগ, কিন্তু এবার ডগেট প্রস্তুত—মানসিকভাবে আরও কঠিন ও পরিণত

সাত বছর আগে প্যাট কামিন্স এবং জশ হ্যাজলউড হঠাৎ চোটে পড়লে যেভাবে ডগেট প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই এবার আবার সেই দু’জনের চোটই তাঁর জন্য স্বপ্নের দরজা খুলে দিয়েছে। তবে এবার তিনি আর সেই হতভম্ব তরুণ নন—এবার প্রস্তুত, পরিণত, দায়িত্ববান এবং আত্মবিশ্বাসী।

ডগেট নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

“আমার জীবনে যেন দুটো অধ্যায় ছিল—একটা কাঠমিস্ত্রির জীবন, আরেকটা পেশাদার ক্রিকেটারের। আর যদি এই সপ্তাহেই টেস্ট অভিষেক হয়, তবে সেটাই হবে জীবনের তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় অধ্যায়।”

কার্পেন্টার থেকে ক্রিকেটার—ডগেটের শেকড় ও শুরুর গল্প

রকহ্যাম্পটনে জন্ম নেওয়া ডগেটের পরিবার মূলত নিউক্যাসল অঞ্চলের ওয়ারিমি আদিবাসী সম্প্রদায়ের। ছোটবেলায় তাঁদের জীবন ছিল শ্রম আর সংগ্রামময়। ডগেটের বাবা ছিলেন পেশায় কার্পেন্টার, আর সেই সূত্রেই শৈশবে ছেলের জীবনে এসেছে কাঠমিস্ত্রির কাজের ছোঁয়া।

কার্পেন্ট্রি কোর্স প্রায় শেষ হওয়ার সময়ই তাঁর জীবনে আসে প্রথম বড় মোড়।

ওয়েস্টার্ন সাবার্বস ক্লাবে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে কুইন্সল্যান্ড তাঁকে রুকি কন্ট্রাক্ট দেয়। সেই চুক্তিই খুলে দেয় তাঁর পেশাদার ক্রিকেটের দরজা।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো—

জাতীয় দলের ডাক পাওয়ার পরও তিনি নিজেকে মূলত কার্পেন্টারই ভাবতেন।

এটাই তাঁর সরলতা এবং মাটির মানুষ হয়ে থাকার প্রমাণ।

দুই গ্রেড ক্রিকেট থেকে হঠাৎ টেস্ট দলে—২০১৮ সালের সেই অবিশ্বাস্য ডাক

মাত্র তিন বছর আগে পর্যন্ত তিনি খেলছিলেন দ্বিতীয় গ্রেড ক্লাব ক্রিকেট। তারপরই ২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হঠাৎ করে জাতীয় দলের ডাক!
ডুবাইয়ের মরুভূমিতে কঠিন ফিটনেস ক্যাম্পে তাঁকে মনে হয়েছিল যেন এয়ার ফোর্সের কোনো বিশেষ অভিযান চলছে।

ডগেটের কথায়:

“সেই ট্রেনিং আমাকে বুঝিয়েছে—আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসলে কতটা কঠিন ও চাহিদাসম্পন্ন।”

যদিও তখন সুযোগ পেলেও অভিষেক হয়নি। এবার সেই অপেক্ষা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

হঠাৎ খবর: ট্রাভিস হেড এসে জানালেন—“তুমি দলে!”

গত সপ্তাহেই শিল্ড ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ডগেট। ঠিক সেই সময় ট্রাভিস হেড দৌড়ে এসে তাঁকে জানালেন—সে দলে নেওয়া হয়েছে।

ডগেট বলেন:

“মাথা যেন হাজার মাইল বেগে দৌড়াচ্ছিল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আবারও জাতীয় দলের ডাক!”

এমন চমকপ্রদ মুহূর্ত যে কোনো ক্রীড়াবিদকে শিহরিত করে দেয়।

সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত এবং নতুন করে উঠে দাঁড়ানো

২০২১ সালে কুইন্সল্যান্ড ছেড়ে সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর একটি।
• প্রিয় দল,
• পরিচিত সতীর্থ,
• এবং সবচেয়ে বড় কথা—অনেকদিনের বোলিং কোচ অ্যান্ডি বিচেলকে পিছনে রেখে নতুন দলে যাওয়া সহজ ছিল না।

শুরুতে তিন মৌসুম চোটে ভুগলেন। তবুও হাল ছাড়েননি।

গত দুই মৌসুমে সে পরিশ্রমের ফল মিললো—ডগেট যেন একেবারে নতুন রূপে ফিরে এলেন।

  • ৬৬ উইকেট
  • গড় মাত্র ২১.১৬
  • সাউথ অস্ট্রেলিয়ার শিল্ড জয়ের নায়ক
  • ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে ১৫ রানে ৬ উইকেট
  • দুই মৌসুম ধরে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বিবেচনায় এখন “মূল দলের বাইরে সেরা পেসার” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন ৩১ বছর বয়সী ডগেট।

গিলেস্পি ও রায়ান হ্যারিসের অধীনে পরিণত ডগেট

টেস্ট কিংবদন্তি জেসন গিলেস্পি এবং রায়ান হ্যারিসের তত্ত্বাবধানে ডগেট তাঁর বলিংয়ে এনেছেন গতি, বৈচিত্র্য ও স্থিতিশীলতা। আগে তাঁর বোলিং ছিল অনেকটাই কাঁচা প্রতিভার ওপর নির্ভরশীল। এখন তিনি বুঝে বল করতে পারেন, পরিস্থিতি বিচার করতে পারেন, দীর্ঘ স্পেলে বল করতেও সক্ষম।

কোচদের মতে—

ডগেট এখন শুধুই একজন প্রতিভা নন; তিনি একজন বুদ্ধিদীপ্ত, পরিকল্পনাবান পেস বোলার।

পরিবার, সন্তান এবং শিকড়—ডগেটের অনুপ্রেরণা

ডগেটের দুই বছর ছয় মাস বয়সী এক ছেলে রয়েছে, আর আগামী মার্চে তাঁর কন্যাসন্তানের জন্ম হওয়ার কথা। পরিবারই তাঁর অনুপ্রেরণা।

শেকড়ের মানুষরাও তাঁকে দোয়া করেছে। তিনি বলেন—

“তোওউম্বায় গেলে এখনও আমি আগের মতোই কার্পেন্টার হয়ে যাই।
সহকর্মীরা আমাকে শুভেচ্ছা পাঠায়, পুরোনো বস ফোন করে খোঁজ নেন।
নেইলব্যাগ বেঁধে কাজে নেমে পড়লে মনে হয়—জীবন আসলে কত সহজ ছিল!”

অ্যাশেজের উত্তাপ—পার্থে সব চোখ এখন ডগেটের দিকে

অস্ট্রেলিয়া–ইংল্যান্ড ম্যাচ মানেই উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়। আর সেটি যদি অ্যাশেজ হয়—তাহলে তো কথাই নেই!
ক্রিকেটবিশ্ব তাকিয়ে আছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্টের প্রথম বলেই কি দেখা যাবে নতুন মুখ—ব্রেন্ডান ডগেটকে?

  • প্যাট কামিন্স এখনো পুরোপুরি ফিট নন
  • হ্যাজলউড চোটে
  • শন অ্যাবট ছিটকে গেছেন
  • স্কট বোল্যান্ডের ফর্ম প্রশ্নবিদ্ধ
  • মাইকেল নেসারও চোটে

সব মিলিয়ে, টিম ম্যানেজমেন্ট ডগেটকে দলে রাখার ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী।

ঘোষণা শুধু আনুষ্ঠানিকতা—ক্রিকেটবিশ্ব অপেক্ষা করছে ডগেটের অভিষেকের।

আগামী শুক্রবার পার্থে শুরু হবে অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট।

কেন ডগেটকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস? বিশেষজ্ঞদের মত

ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে—

গতি ও বাউন্স—পার্থের উইকেটে ভয়ংকর হতে পারেন তিনি

ডগেটের উচ্চতা, অ্যাকশন এবং বাউন্স ব্যবহারের দক্ষতা তাকে ওয়াকা বা পার্থ স্টেডিয়ামের আদর্শ বোলার করে তুলেছে।

রেড বল ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা

গত ২ মৌসুমে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লিগের সেরা পেসারদের একজন।

অ্যাশেজের মতো কঠিন সিরিজে তাজা ও ক্ষুধার্ত বোলার প্রয়োজন

ডগেট সেই মানসিক শক্তি ও ক্ষুধা রাখেন।

অস্ট্রেলিয়ার বোলিং রোটেশনে প্রয়োজন ব্যাকআপ

কামিন্স, হ্যাজলউড, স্টার্ক—তিন জনই গত কয়েক বছরে নিয়মিত চোটে ভুগেছেন।

ফলে ডগেটের মতো নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী এবং পরিণত বোলারকে পাওয়া টিম অস্ট্রেলিয়ার জন্য আশীর্বাদ।

কাঠমিস্ত্রি থেকে অ্যাশেজ—ডগেটের গল্পে যে অনুপ্রেরণা লুকিয়ে আছে

ব্রেন্ডান ডগেটের গল্প শুধু ক্রিকেট নয়—এ গল্প পরিশ্রম, আশা, ধৈর্য এবং বিশ্বাসের গল্প।
যে ছেলে একসময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে-ঘামে কাঠের কাজ করতো, সেই ছেলেই এখন অস্ট্রেলিয়ার জার্সি পাওয়ার দোরগোড়ায়।

এ গল্প শেখায়—

  • সুযোগ একদিন আসবেই
  • সেই সুযোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়
  • শ্রমের বিকল্প নেই
  • নিজের পথ কখনো ছেড়ে দিতে নেই

আর ডগেট নিজের কথায় বলেন—

“ক্রিকেট আমার সব কিছু নয়। জীবন অনেক সহজ ছিল আগেও।
দিনে কাঠের কাজ করতাম, রাতে ক্রিকেট খেলতাম।
এখনকার সবই আমার কাছে বোনাস মনে হয়।”

এটাই তাঁকে আলাদা করে।

শেষ কথা—অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে নতুন অধ্যায় খুলছে?

অ্যাশেজ মানেই তীব্র উত্তেজনা, মর্যাদার লড়াই, দেশের সম্মানের লড়াই।
যদি ব্রেন্ডান ডগেট এই সিরিজে অভিষেক করেন, তাহলে এটি হবে ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় অভিষেকগুলোর একটি।

দরজা ইতিমধ্যে খুলে গেছে।
এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা।

MAH – 13865 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button