ক্রিকেট

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে উইলিয়ামসনের বিদায়

Advertisement

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। ব্ল্যাকক্যাপসদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ও নেতৃত্বের প্রতীক কেইন উইলিয়ামসন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।
রবিবার এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (NZC) উইলিয়ামসনের অবসরের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

টি-টোয়েন্টিতে উজ্জ্বল এক অধ্যায়ের ইতি

দীর্ঘ ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শেষে উইলিয়ামসন নিজেই জানিয়েছেন, সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার।
তিনি বলেন—

“টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এই ফরম্যাটে দেশের জার্সি গায়ে খেলতে পারা আমার জন্য গর্বের। তবে এখন আমি মনে করি, দলের তরুণদের সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। এই পথচলায় যারা আমাকে ভালোবেসেছেন, সমর্থন করেছেন— সবাইকে ধন্যবাদ।”

উইলিয়ামসনের এই বক্তব্যে ফুটে উঠেছে তাঁর বিনয় ও দলের প্রতি আত্মত্যাগের মনোভাব, যা তাঁকে করে তুলেছিল আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।

সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে লম্বা সাফল্যের গল্প

২০১১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় উইলিয়ামসনের। এরপর থেকে তিনি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারের স্তম্ভ।
ক্যারিয়ারের ৯৩ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ২,৫৭৫ রান, গড় ৩৩, এবং স্ট্রাইক রেট প্রায় ১২০। করেছেন ১৮টি অর্ধশতক, সর্বোচ্চ ইনিংস ৯৫ রান
তিনি নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি রান সংগ্রাহক, শুধুমাত্র মার্টিন গাপটিলের পরেই।

ব্যাট হাতে নির্ভরযোগ্যতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক অসাধারণ কৌশলী অধিনায়ক। ২০১৬ ও ২০২২ সালের দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আর ২০২১ সালে, তাঁর শান্ত নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড পৌঁছেছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে — যেখানে তারা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ট্রফির খুব কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছে।

একজন পরিপূর্ণ অধিনায়কের প্রতিচ্ছবি

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে উইলিয়ামসন শুধু একজন ব্যাটার বা অধিনায়ক নন, তিনি ছিলেন দলের সংস্কৃতির প্রতীক।
তাঁর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড দল সারা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে হয়ে উঠেছিল “সৌজন্যপূর্ণ কিন্তু ভয়ংকর প্রতিপক্ষ” হিসেবে পরিচিত।
ক্রিকেট বিশ্লেষক ও সাবেক খেলোয়াড়রা প্রায়ই বলেন, উইলিয়ামসন হচ্ছেন “ক্রিকেটের ভদ্রলোক” — যিনি প্রতিটি ম্যাচে জয়ের পাশাপাশি শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন প্রতিপক্ষেরও।

ইএসপিএনক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, “উইলিয়ামসন এমন এক নেতৃত্বের ধারক, যিনি কৌশল, মনোবল ও সহানুভূতির মিশেলে দলকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁর মতো শান্ত কিন্তু দৃঢ় অধিনায়ক আধুনিক যুগে বিরল।”

অবসরের পেছনের কারণ

উইলিয়ামসন যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি, তবে জানা গেছে, তিনি পরিবারকে আরও বেশি সময় দিতে চান এবং তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে মনোযোগ দিতে ইচ্ছুক।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে তাঁর চাহিদা আকাশচুম্বী। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), বিগ ব্যাশ, দ্য হান্ড্রেড, ও ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগসহ একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ইতোমধ্যেই তাঁকে দলে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সম্পূর্ণ সরে যাচ্ছেন না তিনি। এখনো ওয়ানডে ও টেস্ট ফরম্যাটে খেলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজকে সামনে রেখে তিনি বর্তমানে প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

টেস্ট ও ওয়ানডেতে নতুন লক্ষ্য

উইলিয়ামসন বলেন,

“টেস্ট ক্রিকেট আমার কাছে এখনো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি আমার ক্যারিয়ারের এই পর্বে মনোযোগ দিতে চাই দীর্ঘ ফরম্যাটে, যেখানে আমি দলের জন্য আরও অবদান রাখতে পারব।”

তিনি আরও যোগ করেন,

“ব্ল্যাকক্যাপস শুধু একটি দল নয়, এটি আমার জীবনের অংশ। যতদিন সম্ভব, আমি আমার সবটুকু দিয়ে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে চাই।”

উল্লেখ্য, বর্তমানে টেস্ট ফরম্যাটে উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটারদের একজন। তাঁর টেস্ট গড় ৫৩-এর ওপরে, এবং ওয়ানডেতে রান ৭,০০০ এরও বেশি।

বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতিক্রিয়া

উইলিয়ামসনের এই সিদ্ধান্তে বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট মহলে নেমেছে এক ধরনের নস্টালজিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ টুইট করে বলেন,

“উইলিয়ামসনের মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছিল সৌভাগ্যের। তিনি ক্রিকেটের প্রকৃত ভদ্রলোক।”

ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটার বিরাট কোহলিও সামাজিক মাধ্যমে লেখেন,

“তোমার ক্যারিয়ার অনুপ্রেরণার। মাঠে তোমার উপস্থিতি সবসময়ই ক্রিকেটকে আরও সুন্দর করেছে।”

ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জস বাটলার বলেন,

“উইলিয়ামসন এমন একজন ক্রিকেটার, যিনি দেখিয়েছেন কীভাবে জয় ও সম্মান একসঙ্গে অর্জন করা যায়।”

একটি প্রজন্মের অনুপ্রেরণা

কেইন উইলিয়ামসন শুধু নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার নন— তিনি সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বের জন্য একটি অনুপ্রেরণা।
তাঁর ধৈর্য, কৌশল, ও নম্রতা নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের শেখার মতো উদাহরণ।
তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব মানে শুধু কৌশল নয়, বরং দলকে বিশ্বাস করানো, অনুপ্রাণিত করা, এবং চাপের মুহূর্তে শান্ত থাকা।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক কোচ গ্যারি স্টেড বলেন,

“উইলিয়ামসন এমন একজন নেতা, যিনি শুধু ফলাফলের দিকে তাকাননি। তিনি খেলোয়াড়দের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।”

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নতুন অধ্যায়

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ালেও, উইলিয়ামসনকে খুব শিগগিরই আবার দেখা যাবে বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে।
বিশেষত আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ও পরবর্তীতে গুজরাট টাইটান্সের হয়ে তাঁর অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিজ্ঞতা ও শান্ত নেতৃত্বগুণের কারণে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তাঁর ভূমিকা এখনো গুরুত্বপূর্ণ থাকবে।

উইলিয়ামসনের বিদায়, তবে গল্প শেষ নয়

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে উইলিয়ামসনের অবসর নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটের জন্য এক যুগের সমাপ্তি।
তবে তাঁর অবদান, তাঁর শেখানো মূল্যবোধ এবং তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করবে।

উইলিয়ামসন নিজেই বলেছেন,

“অবসর মানে বিদায় নয়। এটি কেবল নতুন অধ্যায়ের শুরু।”

নিঃসন্দেহে, সেই নতুন অধ্যায়েও উইলিয়ামসন ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে রয়ে যাবেন চিরসবুজ এক নাম হিসেবে।

MAH – 13584 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button