৪২ বছর পর ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্ম দিল নিউজিল্যান্ড। এক সময়ের পরাশক্তি ইংল্যান্ডকে ৩–০ ব্যবধানে হারিয়ে হোয়াইটওয়াশ করেছে কিউইরা। ১৯৮৩ সালের পর এই প্রথম ইংল্যান্ডকে কোনো ওয়ানডে সিরিজে এমনভাবে হারানোর কৃতিত্ব অর্জন করল ব্ল্যাক ক্যাপসরা।
শেষ ম্যাচে ওয়েলিংটনের স্কাই স্টেডিয়ামে দুই দলের লড়াই জমে উঠেছিল রোমাঞ্চের চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত মিচেল স্যান্টনারের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড ২ উইকেটের জয় তুলে নেয় এবং সিরিজ জিতে নেয় ৩–০ ব্যবধানে।
ওয়েলিংটনের নাটকীয় জয়
প্রথম দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। তাই শেষ ম্যাচে তাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা। রান তাড়ায় নামার পরই দেখা যায় রাচিন রবীন্দ্র ও ড্যারিল মিচেলের দৃঢ় ব্যাটিং।
রাচিন ৪৬ রান এবং মিচেল ৪৪ রান করে দলের ভিত গড়ে দেন। এরপর কিছুটা বিপর্যয়ে পড়ে কিউইরা, যখন ইংলিশ বোলাররা নিয়মিত ব্যবধানে উইকেট নিতে শুরু করে। ১৯৬ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে যখন ম্যাচ প্রায় হাতছাড়া, তখন মাঠে নামেন দুই পেসার জ্যাকারি ফোকস ও ব্লেয়ার টিকনার।
এই জুটি অসাধারণ ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে মাত্র ৩৭ বলে ৩০ রানের অপরাজিত পার্টনারশিপ গড়ে নিউজিল্যান্ডকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। ফোকস অপরাজিত থাকেন ১৪ রানে, টিকনার ১৮ রানে।
এ ছাড়া ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ডেভন কনওয়ে (৩৪) ও স্যান্টনার (২৭)।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ধস
এর আগে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডের ইনিংস এক কথায় ছিল বিপর্যয়। নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়ে ইংলিশ টপ অর্ডার। ৯৭ রানে যখন ৬ উইকেট হারিয়ে বসেছে, তখন মনে হচ্ছিল দলটি ২০০ রানও ছুঁতে পারবে না।
কিন্তু পেস বোলিং অলরাউন্ডার জেমি ওভারটন একাই দাঁড়িয়ে যান দলের জন্য। তার ৬২ বলে লড়াকু ৬৮ রানের ইনিংসই ইংল্যান্ডকে ২২২ রানে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে জস বাটলার (৩৮) ও ব্রাইডন কার্স (৩৬) কিছুটা লড়াই করেন।
তবে বাকি ব্যাটারদের অবদান ছিল নামমাত্র। নিউজিল্যান্ডের পেস ও স্পিন মিলিয়ে গড়া আক্রমণের সামনে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন ধসে পড়ে ঠিক যেন তাসের ঘরের মতো।
ইংল্যান্ডের লজ্জাজনক রেকর্ড
এই সিরিজে ইংল্যান্ড কেবল হোয়াইটওয়াশই হয়নি, বরং গড়েছে এক বিব্রতকর রেকর্ডও। তিন ম্যাচে ইংল্যান্ডের প্রথম চার ব্যাটার মিলে করেছেন মাত্র ৮৪ রান—যা ওয়ানডে সিরিজ ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
এর আগে এই রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের দখলে। ১৯৮৮ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের প্রথম চার ব্যাটার মিলে করেছিলেন ৮৯ রান। কিন্তু এখন সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন “লজ্জার ইতিহাস” লিখেছে ইংল্যান্ড।
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিসংখ্যানই বোঝায় ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারের ভয়াবহ দুর্বলতা এবং নিউজিল্যান্ডের বোলারদের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ।
ব্লেয়ার টিকনার—নিউজিল্যান্ডের বোলিং হিরো
ম্যাচজুড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম ছিল ব্লেয়ার টিকনার। ৬৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তিনি হয়ে যান ম্যাচসেরা। ধারাবাহিকভাবে তিনি ইংল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডার ভেঙে দেন, বিশেষ করে বাটলার ও ব্রুকের মতো বিপজ্জনক ব্যাটারদের ফিরিয়ে দিয়ে।
এছাড়াও দারুণ বোলিং করেছেন জ্যাকব ডাফি (৩/৫৬) ও জ্যাকারি ফোকস, যারা পুরো ম্যাচজুড়ে ইংল্যান্ডের উপর চাপ বজায় রাখেন। টিকনার বলেন,
“এই জয় শুধু আমাদের দলের নয়, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ইতিহাসেরও গর্বের মুহূর্ত। ইংল্যান্ডকে এমনভাবে হারানো সহজ নয়।”
ড্যারিল মিচেল—সিরিজের সেরা পারফর্মার
সিরিজজুড়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জন্য সিরিজসেরা নির্বাচিত হয়েছেন ড্যারিল মিচেল। ব্যাট হাতে দলের সংকটময় সময়ে তার ইনিংসগুলো নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেছে প্রতিটি ম্যাচেই।
প্রথম ওয়ানডেতে তার ৯২ রানের ইনিংস, দ্বিতীয় ম্যাচে ৭১ রান এবং শেষ ম্যাচে ৪৪ রান—সবগুলোই ছিল দলের জন্য অমূল্য অবদান।
কিউই ক্রিকেটে নতুন দিগন্ত
এই জয় শুধু একটি সিরিজ জয় নয়, বরং নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বিশ্বকাপ ও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ধারাবাহিক পারফর্ম করেছে, তবে ইংল্যান্ডের মতো দলকে ৪২ বছর পর হোয়াইটওয়াশ করা তাদের আত্মবিশ্বাসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল।
সিরিজের পর নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার বলেন,
“আমরা জানতাম এটা কঠিন সিরিজ হবে। কিন্তু দলের সবাই নিজেদের শতভাগ দিয়েছে। আমাদের তরুণ বোলাররা দারুণ করেছে, ব্যাটাররাও দায়িত্বশীল ছিল।”
ইংল্যান্ডে বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
ইংল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম ও ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এই হোয়াইটওয়াশকে “সতর্কবার্তা” হিসেবে দেখছেন।
বিশ্বকাপের আগে দলের ব্যাটিং লাইনআপ ও নেতৃত্বে পরিবর্তনের দাবি উঠেছে ইংল্যান্ডে।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন বলেন,
“আমাদের ক্রিকেটে নতুন পরিকল্পনা দরকার। নিউজিল্যান্ডের মতো দল এখন আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে কৌশলে ও মানসিকতায়।”
সিরিজের সারসংক্ষেপ
| ম্যাচ | ফলাফল | জয়ী দল | ম্যাচসেরা |
|---|---|---|---|
| ১ম ওয়ানডে | নিউজিল্যান্ড জয় | নিউজিল্যান্ড | ড্যারিল মিচেল |
| ২য় ওয়ানডে | নিউজিল্যান্ড জয় | নিউজিল্যান্ড | রাচিন রবীন্দ্র |
| ৩য় ওয়ানডে | নিউজিল্যান্ড জয় (২ উইকেটে) | নিউজিল্যান্ড | ব্লেয়ার টিকনার |
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ইংল্যান্ড: ৪০.২ ওভারে ২২২ (ওভারটন ৬৮, কার্স ৩৬; টিকনার ৪/৬৪, ডাফি ৩/৫৬)
নিউজিল্যান্ড: ৪৪.৪ ওভারে ২২৬/৮ (রবীন্দ্র ৪৬, মিচেল ৪৪; ওভারটন ২/৩২, কারেন ২/৪৬)
ফলাফল: নিউজিল্যান্ড ২ উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরা: ব্লেয়ার টিকনার
সিরিজসেরা: ড্যারিল মিচেল
সিরিজ ফলাফল: নিউজিল্যান্ড ৩–০ তে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ
নিউজিল্যান্ডের এই জয় শুধু একটি ক্রিকেট সিরিজের জয় নয়—এটি এক যুগের প্রত্যাবর্তন। ইংল্যান্ডের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলকে এমনভাবে হারানো প্রমাণ করে যে কিউই ক্রিকেট এখন আরও পরিণত, পরিকল্পিত ও শক্তিশালী।
আগামী বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে তাই এখন আর “আন্ডারডগ” বলা যাবে না। তারা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ওয়ানডে দল—যারা জানে কীভাবে চাপের মধ্যে থেকেও জিততে হয়।
MAH – 13580 I Signalbd.com



