রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের স্বপ্নভঙ্গ
পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নতুন মৌসুমের শুরুতেই বড় এক ধাক্কা খেয়েছে স্বাগতিকরা। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরে গেছে বাবর আজমের দল।
এই পরাজয়ের ফলে সিরিজে ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে গেলো প্রোটিয়ারা। ম্যাচের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণে ছিলো অতিথিরা, ব্যাটিং থেকে বোলিং—সব দিকেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে তারা।
প্রোটিয়াদের ঝড়ো সূচনা
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর ২০২৫) টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। রাওয়ালপিন্ডির ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট করেন ওপেনার রিজা হেন্ড্রিকস ও কুইন্টন ডি কক। দুজনের ব্যাটে দ্রুত আসে ৫০ রানের উদ্বোধনী জুটি।
ডি কক ২৩ রান করে আউট হলেও হেন্ড্রিকস ছিলেন অসাধারণ ছন্দে। তার ৪০ বলের ইনিংসে আসে ৬টি চার ও ২টি ছক্কার সাহায্যে ৬০ রান।
হেন্ড্রিকসের বিদায়ের পর টনি ডি জর্জি ও জর্জ লিন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে জ্বালিয়ে দেন ঝড়। মাত্র ১৬ বলে ৩৩ রান করেন ডি জর্জি, যেখানে ছিল ৩টি ছক্কা ও ২টি চার। অন্যদিকে লিন্ডে খেলেন ২২ বলে ৩৬ রানের বিধ্বংসী ইনিংস।
তাদের ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৯৪ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে অতিথিরা।
পাকিস্তানি বোলারদের অসহায় লড়াই
পাকিস্তানের বোলারদের মধ্যে একমাত্র মোহাম্মদ নাওয়াজ কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিলেন। তিনি ৪ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়েছেন। এছাড়া সাইম আইউব নিয়েছেন ২টি উইকেট, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের সামনে বাকিরা ছিলেন সম্পূর্ণ অকার্যকর।
হ্যারিস রউফ ও শাহীন শাহ আফ্রিদির মতো অভিজ্ঞ বোলাররাও ছিলেন ব্যর্থ, যা পাকিস্তানের বোলিং লাইনআপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মাঝে।
লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই বিপর্যয়
১৯৫ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ শুরু থেকেই দিশেহারা হয়ে পড়ে। ওপেনার বাবর আজম শুরুতেই আউট হন মাত্র ৯ রান করে। এরপর অধিনায়ক সালমান আলী আগা ৭ বলে মাত্র ২ রান করে ফিরে গেলে চাপ আরও বেড়ে যায় স্বাগতিকদের ওপর।
তৃতীয় ও চতুর্থ উইকেটে কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন সাইম আইউব ও উসমান খান। তবে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকায় কোনো জুটি বড় হতে পারেনি। সাইম আইউব সর্বোচ্চ ৩৭ রান ও মোহাম্মদ নাওয়াজ ৩৬ রান করে দলের সংগ্রহ কিছুটা বাড়ালেও তা ম্যাচে ফেরার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
শেষ পর্যন্ত ১৮.১ ওভারে ১৩৯ রানে অলআউট হয় পাকিস্তান।
দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণ
প্রোটিয়া বোলাররা ছিলেন শুরুর থেকেই ধারাবাহিক। বিশেষ করে করবিন বোশ ছিলেন ভয়ংকর। তিনি ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান দিয়ে ৪টি উইকেট তুলে নেন। তার নিখুঁত লাইন-লেংথে পাকিস্তানি ব্যাটাররা বারবার ভুল শট খেলতে বাধ্য হন।
এছাড়া জর্জ লিন্ডে ৩টি ও লিজার উইলিয়ামস ২টি উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং ধস নামিয়ে আনেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিংও ছিল অনবদ্য। কয়েকটি দুর্দান্ত ক্যাচ ও দ্রুত থ্রো পাকিস্তানের ব্যাটারদের ওপর চাপ তৈরি করে।
ম্যাচের সংক্ষিপ্ত স্কোর
দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ১৯৪/৯
(রিজা হেন্ড্রিকস ৬০, জর্জ লিন্ডে ৩৬, টনি ডি জর্জি ৩৩, কুইন্টন ডি কক ২৩; মোহাম্মদ নাওয়াজ ৩/২৬, সাইম আইউব ২/৩১)
পাকিস্তান: ১৮.১ ওভারে ১৩৯ অলআউট
(সাইম আইউব ৩৭, মোহাম্মদ নাওয়াজ ৩৬, ফখর জামান ২৪; করবিন বোশ ৪/১৪, জর্জ লিন্ডে ৩/৩১, লিজার উইলিয়ামস ২/২১)
ফলাফল: দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ী ৫৫ রানে
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: জর্জ লিন্ডে
সিরিজ অবস্থা: দক্ষিণ আফ্রিকা ১–০ তে এগিয়ে (৩ ম্যাচের সিরিজ)
পাকিস্তানের ব্যর্থতার কারণ
এই পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন—
১. অভিজ্ঞতার অভাব ও নেতৃত্বে অস্থিরতা:
নতুন অধিনায়ক সালমান আলী আগার নেতৃত্বে দল এখনও নিজেদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। টিম কম্বিনেশনে অনিশ্চয়তা ও অভিজ্ঞদের অনুপস্থিতি বড় প্রভাব ফেলেছে।
২. ব্যাটিং অর্ডারে এলোমেলোতা:
বাবর আজম ও ফখর জামানের মতো খেলোয়াড়রা নিজেদের ছন্দে ফিরতে পারেননি। মিডল অর্ডারে সাইম আইউব একা লড়েছেন, কিন্তু সাপোর্ট পাননি অন্যদের কাছ থেকে।
৩. বোলারদের ধার কমে যাওয়া:
শাহীন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ কিংবা হ্যারিস রউফের মতো ফাস্ট বোলাররা এখন আর আগের মতো ভয়ঙ্কর নন। ধারাবাহিকভাবে রান খরচ হচ্ছে, ডেথ ওভারে বোলিংয়ের দুর্বলতা বেড়েছে।
৪. ফিল্ডিংয়ে দুর্বলতা:
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ মিস এবং মিসফিল্ড ম্যাচের গতি পাল্টে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বড় স্কোর গড়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন মুখদের ঝলক
দক্ষিণ আফ্রিকার এই জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের তরুণ খেলোয়াড়রা। টনি ডি জর্জি ও করবিন বোশের মতো ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন।
বিশেষ করে বোশের আগ্রাসী বোলিং পাকিস্তান ব্যাটারদের পুরোপুরি দমিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে লিন্ডে তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যাচের সেরা হয়েছেন, যা প্রমাণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন নতুন প্রজন্মের শক্তিশালী দল গড়ে তুলছে।
বাবর আজমের প্রতিক্রিয়া
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাবর আজম বলেন,
“আমরা ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ হয়েছি। প্রথম ১০ ওভারে উইকেট হারানোই আমাদের ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ভালো খেলেছে, তবে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে।”
অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ডেভিড মিলার বলেন,
“আমাদের পরিকল্পনা ছিল আক্রমণাত্মক খেলা। সবাই নিজেদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছে। এই জয় আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেবে।”
পরবর্তী ম্যাচের চ্যালেঞ্জ
সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে আগামী শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) লাহোরে। পাকিস্তানের সামনে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ। সিরিজে টিকে থাকতে হলে এই ম্যাচে জয় ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
দলের ব্যবস্থাপনা জানিয়েছে, ব্যাটিং অর্ডারে কিছু পরিবর্তন আনা হতে পারে, বিশেষ করে ওপেনিং জুটিতে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে।
ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রতিক্রিয়া
ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তান দলের পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেক ভক্ত বাবর আজম ও দলের কোচিং স্টাফের সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তান ক্রিকেটে এখন বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থকেরা খুশি তাদের দলের তরুণদের পারফরম্যান্সে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের এই বড় হার আবারও মনে করিয়ে দিলো—দলটির সামনে এখন পুনর্গঠনের সময় এসেছে। অভিজ্ঞদের সঙ্গে তরুণদের সঠিক ভারসাম্য তৈরি না করলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে টিকে থাকা কঠিন হবে।
তবে ক্রিকেট অজানার খেলা। পরের ম্যাচেই হয়তো অন্য চিত্র দেখা যেতে পারে—যদি পাকিস্তান তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
MAH – 13527 I Signalbd.com



