
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজনীতি ঢুকে পড়া নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক পাকিস্তান–আফগানিস্তান উত্তেজনা যেন এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। সীমান্তের সংঘাত এবার ছুঁয়ে ফেলেছে ক্রিকেটকেও। বিমান হামলায় প্রাণ হারানো আফগান ক্রিকেটারদের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দুই দেশের সম্পর্ক। আর এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-কেও টেনে এনেছে পাকিস্তান। তাদের অভিযোগ, আইসিসি আসলে আফগানিস্তানের পক্ষেই কাজ করছে।
পটভূমি: সীমান্ত সংঘাতের রেশ ক্রিকেটে
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি ও বিমান হামলার খবর এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় আরগুন এলাকায় পাকিস্তানি বিমান হামলায় কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন বলে দাবি করে কাবুল। নিহতদের মধ্যে তিনজন স্থানীয় ক্রিকেটারও ছিলেন— হারুন, কবির আগা ও সিবগাতুল্লাহ।
এই খবর প্রকাশের পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানায়, “আমাদের তিনজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে হারিয়েছি। এই নির্মম হামলার দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইসিসির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
আইসিসি সেই পোস্টে সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং এসিবির পাশে থাকার বার্তা দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
পাকিস্তানের অভিযোগ: ‘আইসিসি একতরফা ভূমিকা নিচ্ছে’
আইসিসির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয় পাকিস্তান। দেশটির তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এক্স (পূর্বে টুইটার) অ্যাকাউন্টে লেখেন,
“আইসিসি কোনো তদন্ত ছাড়াই একটি বিতর্কিত দাবিকে সত্য ধরে নিয়েছে। তিনজন আফগান ক্রিকেটার বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন— এমন অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। এটি পাকিস্তানকে দোষারোপ করার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।”
তিনি আরও বলেন, “আইসিসি ও এসিবির মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ রয়েছে। আইসিসির বিবৃতি প্রকাশের পরপরই এসিবির পোস্টটি আসে, যেন পুরো বিষয়টি আগে থেকেই সাজানো ছিল।”
পাকিস্তানের দাবি, এই ঘটনাটি শুধু ক্রিকেটের নয়, বরং তাদের জাতীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা। তারা মনে করছে, আইসিসি নিরপেক্ষ আচরণ করছে না এবং রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হচ্ছে।
আফগানিস্তানের সিদ্ধান্ত: পাকিস্তানে খেলবে না দল
বিমান হামলায় তিন ক্রিকেটারের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে আফগান ক্রিকেট অঙ্গন। জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড়রা— রশিদ খান, মোহাম্মদ নবি, রহমত শাহসহ অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা সবাই একই আহ্বান জানান— “মানবিকতার খাতিরে অন্যায়ের প্রতিবাদ হোক।”
এরপর এসিবি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় যে, তারা পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নেবে না।
সিরিজটিতে অংশ নেওয়ার কথা ছিল পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার। আফগানিস্তানের সরে দাঁড়ানোর পর তাদের জায়গায় আসছে জিম্বাবুয়ে।
ত্রিদেশীয় এই সিরিজ শুরু হবে আগামী ১৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান–জিম্বাবুয়ে ম্যাচ দিয়ে। প্রতিটি দল একে অপরের বিপক্ষে দুইবার করে খেলবে এবং সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দুটি দল ২৯ নভেম্বর ফাইনালে মুখোমুখি হবে।
আইসিসির অবস্থান: মানবিক বিবৃতি, না রাজনৈতিক?
আইসিসির বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। খেলাধুলা শান্তির বার্তা বহন করে, তাই প্রতিটি প্রাণের মূল্য অপরিসীম।”
এই বক্তব্যকে ঘিরেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। পাকিস্তান মনে করছে, আইসিসি তদন্তের আগেই পক্ষ নিচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান বলছে, আইসিসির এই বক্তব্য মানবিকতার পরিচায়ক।
ক্রীড়া বিশ্লেষকরা বলছেন, “আইসিসি সাধারণত রাজনৈতিক মন্তব্য থেকে দূরে থাকে। তবে এবার তারা মানবিকতার জায়গা থেকে কথা বলেছে। কিন্তু যেহেতু ঘটনাটি দুটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মধ্যে, তাই স্বাভাবিকভাবেই এতে রাজনৈতিক রঙ লেগে গেছে।”
পাকিস্তানি মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া: ‘আইসিসি নীরব থাকা উচিত ছিল’
পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ঘটনাকে ঘিরে সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকেই বলছেন, আইসিসি উচিত ছিল ঘটনাটি যাচাই না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিবৃতি না দেওয়া। কিছু বিশ্লেষক আবার মনে করছেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেট রাজনীতির নতুন অধ্যায়, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে কূটনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে।
একজন সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেট বোর্ড কর্মকর্তা বলেন, “আইসিসি সবসময় নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবার তারা আবেগে ভেসে গেছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত।”
আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের কান্না
বিমান হামলায় নিহত তিন ক্রিকেটার ছিলেন স্থানীয় ক্লাব পর্যায়ের প্রতিভাবান খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে হারুন ছিলেন বয়সভিত্তিক দলে নিয়মিত, কবির আগা খেলতেন প্রাদেশিক লিগে, আর সিবগাতুল্লাহ সম্প্রতি জাতীয় একাডেমিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তাদের মৃত্যুতে কাঁদছে পুরো আফগান ক্রিকেট মহল। রশিদ খান লিখেছেন, “আমরা শুধু তিনজন সহকর্মীকে নয়, তিনটি স্বপ্নকে হারালাম।”
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলসহ বিভিন্ন প্রদেশে নিহতদের স্মরণে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, অনেক তরুণ ক্রিকেটার এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং মাঠে ফেরার আগ্রহ হারাচ্ছে।
ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
আফগানিস্তানের সরে দাঁড়ানোয় ত্রিদেশীয় সিরিজের গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। জিম্বাবুয়ে অংশ নিলেও দর্শক ও সম্প্রচার স্বত্বে প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তান এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উদীয়মান শক্তি। তাদের অনুপস্থিতিতে সিরিজের প্রতিযোগিতা অনেকটাই একপেশে হয়ে পড়বে।
এদিকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) জানিয়েছে, তারা সিরিজ সফলভাবে আয়োজন করবে। পিসিবির এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা রাজনীতি নয়, ক্রিকেটে বিশ্বাসী। জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কা আমাদের পাশে আছে। সিরিজ যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে।”
তবে আফগানিস্তান বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা পাকিস্তানে কোনো সিরিজ খেলবে না।
বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন প্রশ্ন
এই ঘটনার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন— ক্রিকেট কি এখন সত্যিই রাজনীতির বাইরে আছে?
আইসিসির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক, বোর্ডগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব, সীমান্ত সংঘাত— সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।
একজন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক বলেছেন, “ক্রিকেট ছিল সংযোগের সেতু। কিন্তু এখন সেই সেতুতেই রাজনীতির আগুন লেগেছে। এই আগুন না নেভালে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট দেখা দিতে পারে।”
ক্রিকেটে শান্তির বার্তা ফিরবে কবে?
আফগানিস্তান–পাকিস্তান বিরোধ শুধু দুই দেশের মধ্যকার নয়, বরং এটি বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য একটি সতর্কবার্তা। যুদ্ধ, হামলা বা সীমান্ত উত্তেজনা কখনোই খেলাধুলার পরিসরে ঢোকা উচিত নয়।
আইসিসি ও অন্যান্য ক্রিকেট বোর্ডগুলোকে এখন একটাই বার্তা মনে রাখতে হবে— “ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এটি মানুষের অনুভূতি, এটি জাতির সম্মানের প্রতীক।”
দুই দেশের রাজনীতি যেদিকে যাক না কেন, কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর একটাই আশা— ক্রিকেট মাঠে যেন আবারও দেখা মেলে বন্ধুত্ব, খেলোয়াড়সুলভ আচরণ ও শান্তির বার্তা।
MAH – 13385 I Signalbd.com