
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার (৩০ জুলাই) ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ব্রাজিলীয় পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। নতুন এই আদেশের ফলে মোট শুল্কের হার দাঁড়াল ৫০ শতাংশে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এক নতুন সংকটে ফেলে দিয়েছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এক নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প এই শুল্ক বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। আদেশে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক আলেকজান্দ্রে দে মোরেসের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিপীড়ন, হয়রানি, সেন্সরশিপ এবং বলসোনারো’র বিচারকে প্রভাবিত করার অভিযোগের ভিত্তিতে এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ব্রাজিল-মার্কিন সম্পর্ক: কেন এত উত্তেজনা?
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর পদক্ষেপের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ২০২২ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বলসোনারো ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক আলেকজান্দ্রে দে মোরেস এই তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্রাজিলের বিচার ব্যবস্থার এই ‘অবৈধ পদক্ষেপ’ এবং ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ দমন করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিলীয় পণ্যের ওপর এই উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের হুমকি ও ব্রাজিলের পাল্টা পদক্ষেপ
এই মাসের শুরুতেই ট্রাম্প ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর ‘হয়রানিমূলক ব্যবস্থা’ নিতে থাকে বা বলসোনারোর বিরুদ্ধে ‘অবিচারমূলক’ পদক্ষেপ নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হবে।
এদিকে, ব্রাজিল সরকারও কোনো লাজুকতা দেখাচ্ছে না। তারা হুমকি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে তারা পাল্টা পদক্ষেপ নেবে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করতে পারে।
ব্রাজিলের অর্থনীতিতে প্রভাব: বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশ্ববাজারে ব্রাজিলের পণ্য যেমন কফি, সয়াবিন, গাড়ি ও লৌহ-লোহা সরবরাহের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এসব পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেড়ে যাবে, যার ফলে আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়বে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ব্রাজিলের অর্থনীতিতে এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রাজিলের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়ায়, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ব্রাজিলের রপ্তানি হ্রাস পাবে এবং দেশীয় শিল্পে মন্দার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যত
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা এ ধরনের একপক্ষীয় শুল্ক আরোপকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মাবলীর বিরুদ্ধে যেতে পারে এবং অন্য দেশগুলোও শুল্ক আরোপের মাধ্যমে পাল্টা প্রতিরোধ করতে পারে, যা বিশ্ববাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব চলছে। এই নতুন শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের সম্পর্ককে আরও তীব্র করে তুলতে পারে এবং ভবিষ্যতে বাণিজ্য যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে।
শুল্ক আরোপের রাজনৈতিক পটভূমি ও প্রভাব
ট্রাম্পের প্রশাসনের এ পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চলমান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং ট্রাম্পের কড়া বাণিজ্য নীতির অংশ হিসেবে এই শুল্ক আরোপকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্প নিজ দেশের শিল্প ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা তার নির্বাচনী সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি খাতেও এর প্রভাব কম থাকবে না।
ব্রাজিলের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ব্রাজিল সরকার ইতিমধ্যেই বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আপিল করবে। তারা আশা করছে, অন্যান্য লাতিন আমেরিকার দেশ ও বিশ্ব জনমত তাদের পাশে দাঁড়াবে।
ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার কর্মকর্তারা বলেছেন, “আমরা বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করতে দেব না। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থা আমাদের সবার সম্মান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এই ধরনের শুল্ক আরোপ আমরা মেনে নিতে পারব না।”
সার্বিক বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিশা
ব্রাজিল-মার্কিন শুল্ক সংঘাত ভবিষ্যতে শুধু দুই দেশের মধ্যে নয়, সমগ্র লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে বাণিজ্যিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, বিশ্ববাজারের দামের ওঠানামা ও সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সংকট নিরসনে কূটনৈতিক আলোচনার বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ এবং ভূমিকা জরুরি, যেন বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব সামলানো যায় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমানো যায়।
MAH – 12052, Signalbd.com