আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে পাকিস্তানের বিমান হামলায় অন্তত তিনজন তরুণ আফগান ক্রিকেটার নিহত হয়েছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) রাতে সীমান্তবর্তী ওই প্রদেশে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর একাধিক হামলায় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নিহতরা সবাই আফগানিস্তানের স্থানীয় লিগের ক্রিকেটার ছিলেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (ACB) কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে আসন্ন ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানি হামলায় নিহত তিন আফগান ক্রিকেটার
আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিহত ক্রিকেটাররা হলেন— কবির, সিবগাতুল্লাহ ও হারুন।
তারা পাকতিকা প্রদেশের উরগন জেলা থেকে শরানা শহরে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন। ম্যাচ শেষে ফেরার পথে তারা এক বেসামরিক সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন, তখনই পাকিস্তানি বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমায় প্রাণ হারান তারা।
বোর্ডের বিবৃতিতে বলা হয়—
“উরগনে ফিরে আসার পর এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। এটি পাকিস্তানি সরকারের পরিচালিত এক কাপুরুষোচিত ও অমানবিক হামলা।”
এ ঘটনায় আরও পাঁচজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং অন্তত নয়জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
ত্রিদেশীয় সিরিজ বাতিলের ঘোষণা
আগামী ১৭ থেকে ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোরে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
তবে হামলার পরপরই আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ঘোষণা দেয়—
“এই মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত ক্রিকেটারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং জাতির মান রক্ষার্থে আফগানিস্তান আসন্ন সিরিজে অংশ নেবে না।”
এ সিদ্ধান্তে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (PCB) হতবাক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, “খেলাধুলা কখনো রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার হওয়া উচিত নয়।” তবে আফগানিস্তান জানিয়েছে, “মানবিকতা ও জাতীয় মর্যাদা খেলাধুলার চেয়ে বড়।”
রশিদ খানের আবেগঘন প্রতিক্রিয়া
আফগান টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক রশিদ খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন—
“পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় অসংখ্য নারী, শিশু ও তরুণ ক্রিকেটার প্রাণ হারিয়েছেন। যারা একদিন দেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চে খেলতে চেয়েছিল—তাদের মৃত্যু আমাদের সবার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“বেসামরিক স্থাপনায় এমন বর্বরোচিত হামলা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এ ধরনের হামলার কঠোর নিন্দা জানানো।”
রশিদ খান আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন,
“নিরপরাধ প্রাণ হারানোর পর আমরা মাঠে নামতে পারি না। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কটের সিদ্ধান্ত আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতিফলন।”
মোহাম্মদ নবি ও অন্য ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া
অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবি বলেছেন,
“এটি শুধু পাকতিকা প্রদেশের নয়, গোটা আফগান ক্রিকেট পরিবারের জন্য এক গভীর ট্র্যাজেডি। আমরা আমাদের ভাইদের হারিয়েছি, যারা একদিন আফগানিস্তানের পতাকা উড়াতে চেয়েছিল মাঠে।”
আরেক তরুণ ক্রিকেটার ফজল হক ফারুকি এক্স-এ (টুইটার) লিখেছেন—
“আমাদের ক্রিকেটারদের রক্ত বৃথা যাবে না। আফগান ক্রিকেট আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনের নিন্দা
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (UNHRC) এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কমিশনের মুখপাত্র বলেছেন—
“বেসামরিক জনতার ওপর যেকোনো সামরিক আক্রমণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন। আমরা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানায়—
“খেলাধুলা ও ক্রীড়াবিদরা কোনো যুদ্ধের অংশ নয়। এই হামলা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।”
ক্রিকেট বিশ্বেও এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দাসুন শানাকা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন,
“এমন সময় খেলার কথা ভাবা অসম্ভব। আমরা আফগান ক্রিকেট পরিবারের পাশে আছি।”
যুদ্ধবিরতির পরই নতুন সংঘাত
উল্লেখ্য, ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেই আফগান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।
তিনি বলেছিলেন—
“উসকানি না দিলে আফগানিস্তান কোনো হামলা চালাবে না।”
কিন্তু সেই ঘোষণা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যায় পাকিস্তানের বিমান হামলায়।
এরপর আফগান সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে পাল্টা হামলা চালায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ চলমান রয়েছে, এবং পরিস্থিতি যেকোনো মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
“এই ঘটনার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হবে। বিশেষ করে, আফগানিস্তানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি ক্ষোভ বৃদ্ধি পাবে।”
নিহত ক্রিকেটারদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশজুড়ে শোক
শনিবার সকালে কাবুল, জালালাবাদ ও কান্দাহারসহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে নিহত ক্রিকেটারদের স্মরণে শোক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হাজারো মানুষ হাতে আফগান পতাকা ও ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সামাজিক মাধ্যমে #PrayForAfghanCricketers হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন—
“তারা ক্রীড়াবিদ, সন্ত্রাসী নয়। পাকিস্তান কেন আমাদের সন্তানদের হত্যা করছে?”
বিশ্লেষণ: খেলাধুলা ও রাজনীতি— এক অনন্ত সংঘাত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক বহুদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। সীমান্তে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP) ইস্যু, সন্ত্রাসী আশ্রয় এবং সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে।
এই ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,
“যদি ক্রীড়া সম্পর্কই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলা আরও কঠিন হবে।”
ক্রীড়া বিশ্লেষকরা মনে করেন, আফগানিস্তানের সিদ্ধান্ত সাহসী হলেও, এটি দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেটের কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে।
পটভূমি: আফগানিস্তান-পাকিস্তান ক্রিকেট সম্পর্ক
২০০০ সালের পর থেকে আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঠে আসে মূলত পাকিস্তানের সহায়তায়। অনেক আফগান ক্রিকেটার তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের পেশোয়ার ও করাচিতে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ক্রিকেট সম্পর্কও তিক্ত হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালে একাধিক সীমান্ত সংঘর্ষের পর আফগান বোর্ড পাকিস্তানে অনূর্ধ্ব–১৯ দলের সফর বাতিল করেছিল।
তিন তরুণ ক্রিকেটারের মৃত্যু শুধু একটি খেলার ক্ষতি নয়, বরং একটি জাতির হৃদয়ের ক্ষত।
যারা একদিন আফগানিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন এক নির্মম হামলার কারণে।
আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড, ক্রিকেটার ও সমর্থকরা এক কণ্ঠে বলছেন—
“রক্তের দামে অর্জিত স্বাধীনতা ও মর্যাদা কোনো সিরিজের চেয়ে বড়।”
MAH – 13354 I Signalbd.com



