
মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটে ইতিহাসে এমন দিন খুব কম আসে, যখন একটি দল ৩৩০ রানের মতো বিশাল লক্ষ্য তাড়া করে জয়লাভ করে এবং বিশ্বরেকর্ড গড়ে। ৫২ বছরের মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসে এই ধরণের রেকর্ড ছিল অতি সীমিত। এর আগে এই রেকর্ড কেবল শ্রীলঙ্কার নামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু চলমান বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা ভারতের দেওয়া বিশাল ৩৩০ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ৩ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার এই জয়ে মঞ্চ তৈরি করেছেন দলের অধিনায়ক এবং ওপেনার অ্যালিসা হিলি। ১০৭ বলের ইনিংসে ১৪২ রান করার মাধ্যমে হিলি শুধু ম্যাচ জিতিয়ে দেননি, একই সঙ্গে মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে অনন্য কৃতিত্বও গড়ে তুলেছেন। তার ইনিংসের মধ্যে ছিল ২১টি চার এবং ৩টি ছক্কা। অ্যালিসা হিলির সঙ্গে ছিলেন লিচফিল্ড এবং এলিস পেরি। লিচফিল্ড ৪০ রান করেন, আর পেরি অপরাজিত ৪৭ রানে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
ইতিহাসের বইয়ে অজিদের নাম
মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য তাড়া করে জয়ের রেকর্ডের আগে শীর্ষে ছিল শ্রীলঙ্কা। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত ম্যাচে শ্রীলঙ্কা স্বাগতিক দলের দেওয়া ৩০২ রানের লক্ষ্য ৩৩ বল বাকি থাকতে এবং ৬ উইকেট হাতে রেখে অর্জন করেছিল। সেই ম্যাচে লরা ভলভার্ট ১৮৪ রান করেছিলেন, কিন্তু তা ম্লান হয়ে যায় চামারি আতাপাত্তুর অপরাজিত ১৯৫ রানের অসাধারণ ইনিংসের কাছে।
তবে এবার অস্ট্রেলিয়া সেই রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছে। ভারতের দেওয়া বিশাল ৩৩০ রানের লক্ষ্য তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া দেখিয়ে দিয়েছে, দলগত একতা, অভিজ্ঞতা এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের মিশ্রণে যে কোনো চ্যালেঞ্জ জয় করা সম্ভব।
ভারতের ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স
এদিন ভারতের পক্ষে ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন স্মৃতি মান্ধানা। ৬৬ বলে ৮০ রান করে তিনি নারী ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটার হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে ১ হাজার রান সম্পূর্ণ করার রেকর্ড গড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও মান্ধানা ৫ হাজার রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন, যা তাকে মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশেষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
স্মৃতি মান্ধানা ও জেমিমা রাওয়াল (৭৫ রান) যখন মাঠে ছিলেন, তখন ভারতীয় দল নির্দিষ্ট গতিতে রান তুলছিল। কিন্তু তাদের বিদায়ের পর দলের রান তোলার গতি হঠাৎ কমে যায়। ৩০ ওভারে ১ উইকেটে ১৯২ রান করা ভারত শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৩৮ রান তুলতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার পেসার অ্যানাবেল সাদারল্যান্ড ছিলেন ম্যাচের অন্যতম নায়ক। মাত্র ৪০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে তিনি ভারতের ব্যাটসম্যানদের কাঁপিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া দলের অন্যান্য বোলার যেমন মলিনু এবং চরণীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক
- ভারতের স্কোর: ৪৮.৫ ওভারে ৩৩০ রানের বেশি, যেখানে মান্ধানা ৮০, রাওয়াল ৭৫, দেওল ৩৮, রদ্রিগেস ৩৩ এবং ঘোষ ৩২ রান করেছেন। অ্যানাবেল সাদারল্যান্ড ৫/৪০ এবং মলিনু ৩/৭৫ উইকেট নিয়েছেন।
- অস্ট্রেলিয়ার স্কোর: ৪৯ ওভারে ৩৩১/৭, যেখানে অ্যালিসা হিলি ১৪২, পেরি ৪৭* অপরাজিত, গার্ডনার ৪৫ এবং লিচফিল্ড ৪০ রান করেন। চরণী ৩/৪১ উইকেট নিয়েছেন।
- ফলাফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী।
- ম্যাচসেরা: অ্যালিসা হিলি
অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী দলগত পরিকল্পনা
অস্ট্রেলিয়ার মেয়েদের জয়ে শুধু ব্যাটিং নয়, বোলিং এবং ফিল্ডিংও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। ওপেনিং বোলাররা শুরুতেই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিটি উইকেট গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সেই চাপের মধ্যে অ্যানাবেল সাদারল্যান্ডের বোলিং অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পথে মূল অবদান রেখেছে।
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক এবং কোচের পরিকল্পনা পুরো দলের মধ্যে লক্ষ্য ছিল– ধৈর্য্য ধরে রান তোলা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করা। এই কৌশল কার্যকর হয় এবং অজিদের মেয়েরা দেখিয়ে দেয়, তারা কেন বিশ্ব ক্রিকেটে শীর্ষে।
বিশ্বকাপে টেবল ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই ম্যাচের জয়ের পর অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে ৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। টানা চতুর্থ ম্যাচে এটি তাদের তৃতীয় জয়। অন্যদিকে, ভারত চার ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এই ফলাফল ভারতের জন্য আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে রান তোলার ধীর গতির কারণে।
বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী পারফরম্যান্স এবং ধারাবাহিক জয়ের ফলে তারা ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে ভারতের সামনে এখন আরও কঠিন প্রতিপক্ষ রয়েছে, যারা তাদের খেলা বিশ্লেষণ করে প্রতিটি ম্যাচে নতুন কৌশল নিয়ে আসতে পারে।
মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ডের গুরুত্ব
মেয়েদের ক্রিকেট দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এই ধরনের রেকর্ড গড়ে মেয়েদের ক্রিকেট আরও সমর্থক এবং নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি, অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা দেখিয়েছে যে মেয়েদের ক্রিকেট শুধুমাত্র খেলার দিক দিয়ে নয়, কৌশল, মানসিক দৃঢ়তা এবং শারীরিক সক্ষমতার দিক থেকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমন বিজয় যুবাদের কাছে উদাহরণ হিসেবে থাকবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মেয়েদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
অস্ট্রেলিয়ার এই জয়ের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে, মেয়েদের ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড গড়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্রীড়াজগতে মেয়েদের স্থান কতটা ক্রমবর্ধমান। অ্যালিসা হিলি, এলিস পেরি, লিচফিল্ড এবং পুরো দলের একনিষ্ঠতা এবং দুর্দান্ত পরিকল্পনা এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে।
ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক জানিয়েছেন, “আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি এবং দলগত একতা বজায় রেখেছি। এই জয়ের মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি, বড় লক্ষ্য তাড়া করা সম্ভব।”
ভারতের মেয়েদের জন্য এটি একটি শিক্ষা ও প্রেরণার মুহূর্ত। তারা তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করবে এবং পরবর্তী ম্যাচে আরও শক্তিশালী ফিরে আসবে।
মোটের উপর, এই ম্যাচ কেবল একটি জয়ের কাহিনী নয়, এটি মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত: ৪৮.৫ ওভারে ৩৩০ (মান্ধানা ৮০, রাওয়াল ৭৫, দেওল ৩৮, রদ্রিগেস ৩৩, ঘোষ ৩২; সাদারল্যান্ড ৫/৪০, মলিনু ৩/৭৫)
অস্ট্রেলিয়া: ৪৯ ওভারে ৩৩১/৭ (হিলি ১৪২, পেরি ৪৭*, গার্ডনার ৪৫, লিচফিল্ড ৪০; চরণী ৩/৪১)
ফলাফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরা: অ্যালিসা হিলি
MAH – 13302 I Signalbd.com