ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনার খবর দেশজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। নেতানিয়াহু তার চলমান দুর্নীতি মামলাগুলোর জন্য ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তবে প্রেসিডেন্টের সামনে এখন তিনটি জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, যার মধ্যে যে কোনো পথ বেছে নিলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হবে।
ক্ষমা প্রার্থনার প্রেক্ষাপট
রোববার নেতানিয়াহু আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে চলমান তিনটি দুর্নীতি মামলার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তবে তিনি সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। ইসরাইলি আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো, দোষ স্বীকার ছাড়া ক্ষমা দেওয়া কঠিন। তাই এই আবেদন অনুমোদনের সম্ভাবনা শূন্য নয়, তবে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
একই সঙ্গে দেশটি কার্যত নির্বাচনী পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আগামী অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক উত্তাপের কারণে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বিশিষ্ট বিশ্লেষক বিনি আশকেনাজি মনে করেন, “নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনা রাজনৈতিকভাবে একটি গণনা করা পদক্ষেপ। তিনি জানেন, অনুমোদনের সম্ভাবনা কম, কিন্তু এতে জনসংলাপের দিক বদলে যেতে পারে। জনগণ তার বিরুদ্ধে কৃত দোষের আলোচনার পরিবর্তে ক্ষমা প্রার্থনার বিতর্ক নিয়ে মনোযোগ দেবে, যা রাজনৈতিকভাবে তাকে সুবিধা দিতে পারে।”
প্রেসিডেন্ট হারজগের তিনটি জটিল বিকল্প
ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের সামনে ক্ষমা প্রার্থনার তিনটি বিকল্প রয়েছে, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা আনবে।
১. ক্ষমা আবেদন প্রত্যাখ্যান
সবচেয়ে সরল ও দ্রুত সমাধান হলো ক্ষমা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা।
বিরোধী দলগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, দোষ স্বীকার ছাড়া ক্ষমা অনুমোদন করা সম্ভব নয়। যদি আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে বিরোধীরা সন্তুষ্ট হবেন। তবে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ ও তার মিত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে, এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হতে পারে।
২. ক্ষমা অনুমোদন
ক্ষমা অনুমোদন করা হলে নেতানিয়াহু ও তার দল তৃপ্ত হবেন। এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ১২ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হারজগকে চিঠি পাঠিয়ে ক্ষমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি ইসরাইলি বিরোধীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অনুমোদন দিলে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগীয় সংস্কারবিরোধী আন্দোলনের চেয়েও বড় জনবিক্ষোভ হতে পারে। দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে পারে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিতর্কের সৃষ্টি হবে।
৩. শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা
তৃতীয় সম্ভাবনা হলো শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা। প্রেসিডেন্ট হারজগ নেতানিয়াহুর ক্ষমা মঞ্জুর করতে পারেন, তবে কিছু শর্তে। যেমন:
- নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবন থেকে অস্থায়ী অবসরের শর্ত।
- ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার ওপর সরকারি তদন্ত।
- বিতর্কিত বিচার ও গণমাধ্যম সংস্কার বিল প্রত্যাহার।
ইসরাইলি সরকারি সম্প্রচারক “কান” অনুসারে, প্রেসিডেন্টের দপ্তর মনে করে যে শর্ত ছাড়া ক্ষমা মিলবে না। তবে নেতানিয়াহু রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন না।
নেতানিয়াহু-সমর্থিত চ্যানেল ১৪ জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট হয়তো দোষ স্বীকার না করিয়েই ক্ষমা দিতে রাজি হতে পারেন, তবে আবেদনের ভাষায় কিছু পরিবর্তন চাওয়া হতে পারে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি দুই মাসও লাগতে পারে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান মামলা
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি প্রধান দুর্নীতি মামলা চলছে, যা ইসরাইলের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে।
কেস ১০০০
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিলাসদ্রব্য গ্রহণের বিনিময়ে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ।
কেস ২০০০
ইয়েদিওথ আহরোনথ পত্রিকার প্রকাশকের সঙ্গে সুবিধাজনক কভারেজ পাওয়ার জন্য কথিত সমঝোতা।
কেস ৪০০০
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ। ওয়ালা নিউজ ও বেজেক মালিক শাউল এলোভিচকে নিয়ন্ত্রক সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ইতিবাচক কভারেজ আদায়।
এছাড়াও, ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়াভ গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই অভিযোগের মধ্যে রয়েছে গাজায় বেসামরিক হত্যা, যেখানে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ৭০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব
নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতিকের মনোযোগও আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, ক্ষমা অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান যেকোনো সিদ্ধান্ত ইসরাইলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
যদি ক্ষমা অনুমোদন হয়, তা দেশীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতানিয়াহুর সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে নতুন বিতর্কের সূচনা করবে। আবার, শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা দিলে রাজনৈতিক সমঝোতার নতুন পথ তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ সরকারের নীতিনির্ধারণকে প্রভাবিত করবে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রভাব
ইসরাইলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক সময়ে উত্তপ্ত, যখন দেশের সাধারণ নির্বাচনের সময় ঠিক আসছে। নির্বাচনের আগে ক্ষমা সংক্রান্ত বিতর্ক এবং জনমত রাজনৈতিক দলের কৌশলগত পদক্ষেপকে প্রভাবিত করবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেতানিয়াহু ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজনৈতিকভাবে নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছেন। জনমতকে কেন্দ্র করে ক্ষমা সংক্রান্ত আলোচনার ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়গুলো, যেমন হেরেদিমের খসড়া-ছাড় আইন, কম গুরুত্ব পেতে পারে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের সামনে তিনটি জটিল বিকল্প রয়েছে—আবেদন প্রত্যাখ্যান, অনুমোদন, অথবা শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা। যে পথই বেছে নিন, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া অটল।
নেতানিয়াহুর মামলা, নির্বাচনী প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক চাপ এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মিলিত প্রভাব ইসরাইলের রাজনীতিকে নতুন অধ্যায়ে নিয়ে যাবে।
MAH – 14105 I Signalbd.com



