
গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাতের মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ২৮টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একযোগে ইসরায়েলকে ‘এখনই যুদ্ধ থামানোর’ আহ্বান জানিয়েছে। গাজার ২০ লাখেরও বেশি মানুষের মানবিক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
গাজায় মানবিক দুর্দশা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংঘাত প্রায় ২১ মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে গাজার মানুষের দুর্ভোগ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি মানবিক সহায়তা পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে শিশু, নারী ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।
গাজায় খাদ্যের অভাব ও চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষ করে ইসরায়েল কর্তৃক চলমান অবরোধ ও ত্রাণসামগ্রী সরবরাহে বাধার ফলে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ বেড়েছে, যারা যুদ্ধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে চায়।
২৮ দেশের যৌথ বিবৃতি ও তাদের দাবিসমূহ
এই ২৮ দেশের যৌথ বিবৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
- গাজার যুদ্ধ তৎক্ষণাৎ থামাতে হবে।
- একটি স্থায়ী ও সমঝোতাভিত্তিক অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা করা হোক।
- ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে।
- জরুরি মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবাহিত হতে হবে।
- ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলার জন্য বাধ্য করতে হবে।
- বেসামরিক জনগণকে অবরুদ্ধ না করে তাদের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিস্থিতির কঠোর বিবরণ
জাতিসংঘ ও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাস ধরে ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহে অনেক সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। মে মাসে কিছু শিথিলতার পরেও গাজার অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে ত্রাণ নিতে গিয়েও অন্তত ৮৭৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ঘটনা।
গাজার সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, গত রোববার ৯৩ জন ত্রাণ সংগ্রহকারীকে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই গাজার উত্তরে এবং রাফা ও খান ইউনিসে এলাকায় ছিল। এই হামলা গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করেছে।
গাজায় ত্রাণ বিতরণ ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, গাজা নগরীর কাছে তাদের ২৫টি ত্রাণবাহী ট্রাক পৌঁছানোর সময় হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ সেখানে ভিড় করেছিল। তখনই ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। তবে ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, ওই ভিড় তাদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করায় তারা সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে।
এমন ত্রাণবাহী মানুষের ওপর হামলার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে গাজার সাধারণ মানুষের মানবিক দুর্দশা দিন দিন আরও বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের পথ
গাজার এই সংকট মেটাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডাসহ ২৮ দেশের এই যৌথ বিবৃতি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া জোরদার করার আহ্বান। বিশ্ব নেতারা আশা করছেন, এই ধরনের আন্তর্জাতিক চাপে গাজায় অস্ত্রবিরতি ও মানবিক সাহায্যের অবাধ প্রবাহ দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ, এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও গাজায় অবিলম্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
গাজা সংকটের পেছনের ইতিহাস
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনের সঙ্গে উত্তেজনা ও সংঘাত চলছে। বিশেষ করে গাজা উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরেই অবরুদ্ধ ও যুদ্ধক্ষেত্র। ২০০৭ সাল থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাজায় ইসরায়েল কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে, যার কারণে গাজার মানুষজন চরম মানবিক দুর্ভোগে পড়েছে।
সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যে সহিংসতা চলছে, তা গাজার অবস্থা আরো খারাপ করেছে। ইসরায়েলি বিমান হামলা, রকেট নিক্ষেপ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে হাজার হাজার বেসামরিক লোক মারা গেছে।
গাজার মানুষের জীবনযাত্রা এখন কেমন?
গাজার বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্যসেবা প্রণালী সবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ বাসিন্দা প্রতিদিন খুঁজে বেড়াচ্ছেন খাবার ও পানি। হাসপাতালগুলো ঔষধ ও চিকিৎসক সংকটে ভুগছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অর্থনীতি স্তব্ধ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, গাজায় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, যক্ষ্মা, এবং মানসিক অবসাদের হার ভয়াবহভাবে বাড়ছে। যুদ্ধে হতাহত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংযুক্ত দেশগুলো এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিবৃতিতে যুক্ত থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইত্যাদি রয়েছে। এই দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি তাদের মিত্রতা বজায় রেখেও গাজার মানবিক পরিস্থিতির জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে ইসরায়েলের প্রতি কঠোর হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
গাজার শান্তির একমাত্র উপায়
গাজার দুঃসময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বেসামরিক লোকদের জীবন বাঁচানোই সর্বোচ্চ প্রাধান্য হওয়া উচিত। যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি আলোচনা শুরু করা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।
তাই গাজায় অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি, ত্রাণের অবাধ প্রবাহ এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এর মধ্য দিয়ে গাজার মানুষের ওপর চলমান নিষ্ঠুরতা বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগাতে হবে।